রাজবাড়ীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে দুটি ইউনিয়ন

এম মনিরুজ্জামান, রাজবাড়ী
 | প্রকাশিত : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:১৫

পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে ক্ষণে ক্ষণে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউনিয়ন। এভাবে চলতে থাকলে রাজবাড়ীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ইউনিয়ন দুটি।

গত তিন-চার দিনের অব্যাহত নদীভাঙনে এই দুই ইউনিয়নের হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি বিলীন ও শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এসব পরিবার সরকারি বাঁধে বা রেলসড়কের পাশে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

এদিকে দৌলতদিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ৬ নম্বর ফেরিঘাটটি ভাঙনের মুখোমুখি। অন্য ৫ নম্বর ঘাটটিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে সেখানে বালুর বস্তা ফেলে ঘাট রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, ফেরিঘাট এলাকায় নদীভাঙন শুরু হওয়ায় ৬ নম্বর ঘাটটি হুমকিতে রয়েছে।

নদীভাঙনের শিকার দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের গৃহহীন হয়ে পড়া হাজার হাজার মানুষ ইতিমধ্যে এলাকা ছেড়েছে। এখনই ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা না নিলে গোয়ালন্দের মানচিত্র থেকে এই দুই ইউনিয়ন হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। গত ১৫ বছরে এ উপজেলার ৪৯টি গ্রাম পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে। উপজেলার ১১৪টি গ্রামের মধ্যে এখন পদ্মাবেষ্টিত হয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে বাকি ৬৫টি গ্রামের বাসিন্দারা।

দুই মাস ধরে উপজেলার পদ্মা-তীরবর্তী এলাকা ভাঙছে। দৌলতদিয়ার বেপারীপাড়া, যদুমাতবর পাড়া, দৌলতদিয়ার ৬ নং ঘাট, সিরাজখার পাড়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের চর বরাট, অন্তার মোড়, দেলুনদী, তেনাপচা, দেবগ্রামসহ গ্রামে ভাঙনের তীব্রতা বেশি।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের একটাই দাবি- ‘রিলিফ চাই না, চাই নদীশাসন’। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই শনিবার (সেপ্টেম্বর) দুপুরে নদীতীরে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে হাজারো মানুষ এই দাবি জানান।

নদীভাঙনের তীব্রতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলতে শনিবার সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী, জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী, পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলিসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

প্রতিমন্ত্রী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নদীভাঙন পরিদর্শনে আসার খবর শুনে নদীতীরের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হন ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষ। তাদের মুখে একটাই স্লোগান- ‘রিলিফ চাই না, চাই নদীশাসন’।

শনিবার দুপুরে দেবগ্রাম মধু সরদারপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দু-এক মিনিট পর পর নদীপাড়ের বিশাল অংশ ভেঙে পড়ছে নদীতে। ভয়াবহ এই দৃশ্য দেখতে ভিড় করেছে শত শত মানুষ। এ সময় কথা হয় ১০ নং যদু মাতুব্বার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আকাশ মৃধা ও মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তারা জানান, তারা ২০-২৫ মিনিট আগে এখানে এসেছেন। এই সময়ে তাদের চোখের সামনে অন্তত ১০০ ফুট জায়গা নদীগর্ভে চলে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ বসতভিটে থেকে ঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বসতভিটা থেকে চিরবিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফরিদা বেগম (৪৫) নামের এক গৃহিণী। তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘ঘর ভাইঙ্গা নিয়া এক আত্মীয়র বাড়ি রাখতাছি। সেহানে রাইখা দমডা ফালাই, হেরপর দেহুম কোনে যাওয়ন যায়। এহানেতো ভাঙনের ডরে দম বন্দ হয়া আসতাছে।’

আর একটু এগুতেই চোখে পড়ে একটি পরিবার তাদের ঘর, গরু-ছাগল নিয়ে একটি ট্রলার বোঝাই করে অন্যত্র আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে। নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রত্যেকের চোখে জল। তাদের বিদায় দিতে আসা গ্রামবাসীর চোখেও জল। বিদায় নেয়া পরিবারের সদস্য লালন সরদার (৪৮) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পাগলা নদী আমাগো একসাথে থাকতে দিলো না।’

দেবগ্রামের তোরাপ আলী সরদার (৬০), ফুলচাদ (৪৫), রিজিয়া বেগম (৩৮), আবুল শেখ (৫০), আফছার সরদারসহ (৬৫) অনেকেই জানান, সপ্তাহখানেক ধরে এ এলাকার নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতি মুহূর্তে এ এলাকার মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।

এদিকে রাজবাড়ীর কালুখালীর রতনদিয়া ইউনিয়নের সাদারচর, হরিণবাড়ীয়া, প্লাবিত রাজবাড়ী সেনানিবাস ও জেলা শহরের গোদারবাজার ঘাট এলাকা পদ্মার ভাঙর্নের হুমকিতে রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে রাজবাড়ী শহর রক্ষা বাঁধের নদীর পার সংরক্ষণ গোদারবাজার ঘাটের অবকাশকেন্দ্র ‘বন্ধন’-সংলগ্ন ২০০ মিটার নদী তীর রক্ষা বাঁধ ধসে গেছে। বর্তমানে সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে।

তা ছাড়া কালুখালীর রতনদিয়া এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রাজবাড়ী সেনা ক্যাম্প নামক পিলার থেকে সোয়া কিলোমিটার এসবিবি ইটের রাস্তার কিছু অংশ ও সাদার বাজার সম্পূর্ণ ধসে গেছে। এ ছাড়া লস্করদিয়া নারায়ণপুর গ্রামের কয়েক শ বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে।

রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ সরকার বলেন, বর্তমানে রাজবাড়ী জেলার পদ্মাপাড়ের বেড়িবাঁধের বাইরের বিভিন্ন এলাকায় ৮৭৫ মিটারজুড়ে ভাঙন রয়েছে।

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু নাসার উদ্দিন বলেন, পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন সম্পর্কে ইতিমধ্যে প্রশাসন অবগত হয়েছে। শনিবার শিক্ষা ও জেলা প্রশাসক ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা ভাঙন প্রতিরোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় সম্ভব সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

(ঢাকাটাইমস/৯সেপ্টেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :