সেই যুক্তফ্রন্ট গৌরবের আর এই যুক্তফ্রন্ট তামাশার

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:৩৮

যুক্তফ্রন্ট শুনলেই ইতিহাসের এক গৌরবময় পথচলার স্মৃতি বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠে। ইদানীং ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে আরেকটি রাজনৈতিক (?) প্লাটফর্ম-এর কথা শোনা যায়। নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়। রাজনীতি সচেতনরা চোখ কচলে ভালো করে ইতিহাসের যুক্তফ্রন্ট আর বর্তমানের যুক্তফ্রন্টের চেহারা দেখে বিস্মিত হয়, কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও বাস্তবতার দৃষ্টিতে সামলে ওঠে তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তায়।

এক যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তান আমলে মুক্তিকামী মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি মুসলিম লীগকে নাস্তানাবুদ করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েমের পথ সুগম করেছিল। আর বর্তমানের যুক্তফ্রন্ট এমন এক সময়ে গঠিত হয়েছে যখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। উন্নয়নের পথকে মসৃণ করতে নয়, সরকার পতনের দাবি সামনে রেখে বিএনপি থেকে বিতাড়িত রাজনীতিবিদ বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, আ স ম রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী ‘বঙ্গবীর’ আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও বিএনপির সাদেক হোসেন খোকার সাথে ভাইবার কথোপকথনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রকারী মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য মিলে গড়ে তুলেছে একবিংশ শতাব্দীর এই নতুন ‘যুক্তফ্রন্ট’।

ব্যক্তিগতভাবে ইনাদের সবারই সমৃদ্ধ রাজনৈতিক অতীত রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ নিজেদের কর্মগুণে, কেউ সাবেক দলীয় ব্যানারের জন্য, কেউ আবার নিজের কর্মগুণ এবং দলীয় ব্যানারের শক্তিতে বাংলাদেশের বড় ব্যক্তিত্ব। বি চৌধুরী যেমন স্বনামধন্য চিকিৎসক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি। খালেদা জিয়া বি চৌধুরীকে তো মূল্যায়ন করেনইনি, বরং দলের সন্ত্রাসীরা বি চৌধুরীর মতো একজন মুরব্বি রাজনীতিবিদকে রাজধানীর রেললাইনের ওপর দিয়ে দৌড় দিতে বাধ্য করেছিল!

নব্য এই যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন এক প্রেস কনফারেন্সে অত্যন্ত মজার সব কমেন্ট করেছেন। শুনতে মজার হলেও এসব মন্তব্যের তাৎপর্য অসীম। নেপালের কাঠমান্ডুতে চতুর্থ বিমসটেক সম্মেলনে শেষে দেশে ফিরে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি হাস্যরসাত্মকভাবে রবের সমালোচনা করেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী হাস্যরসাত্মকভাবে বলেন, ‘অসময়ে নীরব, সুসময়ে সরব, তিনি হলেন আ স ম রব’। ড. কামাল হোসেনদের জোট নিয়ে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড. কামাল হোসেন জাতির পিতার ছেড়ে দেয়া সিটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশে একটা শ্রেণি বসেই থাকে যারা নির্বাচনকে বানচাল করতে চায়, নির্বাচন ঠেকাতে চায়। আমার প্রশ্ন হলো ড. কামাল নির্বাচন চায় কি না? তিনি বলেন, বাংলাদেশে দুটি দল আছে একটি হলো আওয়ামী লীগ আর আরেকটি হলো অ্যান্টি আওয়ামী লীগ।

এরপর তিনি জোটের অন্য শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের সমালোচনা করে বলেন, ‘অসময়ে নীরব, সুসময়ে সরব, তিনি হলেন আ স ম রব’। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে সরস মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখতে বললেই উনি জুড়ে দেয় কান্না, তার নাম মান্না।

প্রধানমন্ত্রী মাহমুদুর রহমান মান্না সম্পর্কে বলেন, ‘মান্না একসময় আমাদের দলে (আওয়ামী লীগ) ছিলেন। তিনি বেশ ভালো লেখেন। যখন আওয়ামী লীগে এলেন, আমি বললাম যখন অন্য দল করতেন তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশি বেশি লিখতেন। তো এখন আমাদের পক্ষেও কিছু লেখেন। এ কথা বললেই মান্না জুড়ে দেয় কান্না!

উপরে উল্লেখিত যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সবাই কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। নতুন প্রজন্মের প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানে কি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে ষড়যন্ত্র করে নামিয়ে আনা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে কি তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ’-এর নামে বাংলাদেশের অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রাশ টেনে ধরা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে কি ‘গণতান্ত্রিক মসৃণ পথ’ তৈরি করার নামে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতায় ফেরার পথ সৃষ্টি করা?

যে বিএনপির ভরসায় এই ‘যুক্তফ্রন্ট’ নেতারা বাংলাদেশে বড় পরিবর্তনের আশায় দিন গুনছেন, সেই বিএনপির লোকজন পর্যন্ত তাদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন। ঢাকাটাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘সরকারবিরোধী ঐক্য, নির্বাচন, আন্দোলনের জন্য জাতীয় ঐক্য করতে গিয়ে ছোট ছোট দলগুলোর দাবি শুনে আক্কেলগুড়ুম হওয়ার দশা বিএনপির। জনসমর্থনের বিষয়টি পরীক্ষিত না হলেও বিকল্পধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের যুক্তফ্রন্টই তাদের কাছে চেয়ে বসেছে ৩০০ আসনের ১৫০টি! বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা না হলে আর ভোটে গেলে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।

এদিকে বড় হওয়ার ঘোষণা দিয়ে যুক্তফ্রন্ট ছোট হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকাটাইমস। ঢাকাটাইমস লিখেছে, ‘গঠনের পর আট মাসে যুক্তফ্রন্ট বড় হতে পারেনি এতটুকু। তবে ছোট হয়েছে, সেটা নিশ্চিত। কারণ, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বের হয়ে যাওয়ার পর এখন বিকল্পধারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি আর নাগরিক ঐক্যই এখন শরিক। এর মধ্যে নাগরিক ঐক্যকে রাজধানীকেন্দ্রিক মান্নাসর্বস্ব সংগঠন বলা যায়। জাসদের একাংশ জেএসডির আ স ম আবদুর রবের এককালে লক্ষ্মীপুরের একটি আসন থেকে জিতে আসার ক্ষমতা থাকলেও ১৯৯৬ সালের পর থেকে তিনি যতবার দাঁড়িয়েছেন ততবার তৃতীয় হয়েছেন। আর বিকল্পধারার মুন্সিগঞ্জে একটি আসন ছাড়া কোথাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনসমর্থন শক্তি আছে, সেটারও প্রমাণ নেই।

রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র স্বাধীনের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত প্রতিটি কাজ আওয়ামী লীগের ব্যানারে এক এক করে সমাপ্ত করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। বিএনপি-জামাত জোট এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্থানীয় দোসরদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। কদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ৬৬ শতাংশ নাগরিক বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে দেশের ৬৪ শতাংশ নাগরিক। ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে এ ফলাফল উঠে এসেছে।

৩০ আগস্ট প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইনসাইট অ্যান্ড সার্ভের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ৬৬ শতাংশ নাগরিকের কাছে জনপ্রিয় শেখ হাসিনা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতি ৬৪ শতাংশ নাগরিকের সমর্থন রয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনের নোটে বলা হয়, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। আর সে কারণেই ৬৮ শতাংশ নাগরিক জননিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ মনে করছেন, সামনে জননিরাপত্তা ব্যবস্থার আরো উন্নতি হবে।

শুধু নিজের দেশের মানুষের উন্নয়ন নয়, বিদেশের মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা ‘মানবতার জননী’ খেতাব পেয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোতে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দ্বারা নিপীড়িত মজলুম রোহিঙ্গাদের মায়ের মতো আশ্রয় দিয়ে যে নজিরবিহীন মানবতা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি ইতিহাসের আলোকিত অধ্যায় হয়ে লেখা থাকবে। দেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে ভালোবাসে, বিদেশিরা শেখ হাসিনাকে সম্মান দিয়ে নুয়ে কুর্নিশ জানায়। কিন্তু শেখ হাসিনা কিংবা তাঁর সরকারের কোনো ভালো কাজ নজরে পড়ে না শুধু এই তথাকথিত যুক্তফ্রন্ট, বিএনপি-জামাত জোট আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল গোষ্ঠীর।

দেশের মানুষ বোকা নয়। মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসা দিতে জানে। আরাম কেদারায় বসে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলে কখনোই মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :