নানগাগওয়া কী মুগাবের পথেই?

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:৫১

সুলতানা স্বাতী

জিম্বাবুয়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় এখন এমারসন নানগাগওয়া। বহু নাটকীয়তা, সহিংসতা আর বিতর্কের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত তাকেই জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সাবেক শাসক বরার্ট মুগাবের প্রতিষ্ঠিত দল জানু-পিএফ পার্টির প্রধানও তিনি। গত বছর জানু-পিএফ পার্টির প্রধান থেকে মুগাবেকে বরখাস্ত করা হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন নানগাগওয়া। এর দুদিন পর এক সামরিক অভ্যুত্থানে মুগাবে পদত্যাগ করলে দেশটির অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন তিনি। মুগাবে ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশটির সামনে একটি সুযোগ এসেছিল গণতন্ত্র চর্চার। কিন্তু জিম্বাবুয়ের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নতুন করে প্রমাণ করল, ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করলেও আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।’

যদিও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে কিছুটা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা নেলসন চামিসা। নির্বাচনে ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে তার দল এমডিসি অ্যালায়েন্স পার্টি। আর নানগাগওয়া পেয়েছেন ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। চামিসার দাবি, নানগাগওয়ার জয়ী হওয়া নিয়ে যাতে আন্তর্জাতিক পর্যবেÿক, দাতা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সন্দেহ করতে না পারে, সেজন্যই ভোটের ব্যবধান কমিয়ে দেখানো হয়েছে। আদতে দেশটিতে নাকি ভোটই হয়নি। ভোট শুরুর আগেই ব্যালট পেপারে সিলমারা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন, কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট গণনার আগেই ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণেই চামিসা বলছেন, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোট হলে তিনিই জয়ী হতেন। আর এর কারণ হিসেবে তার দাবি, জানু-পিএফ পার্টির শাসন ব্যবস্থায় অতিষ্ঠ দেশবাসী।

পশ্চিমা বিশ্লেষকদেরও ধারণা, নানগাগওয়া দীর্ঘদিন রবার্ট মুগাবের ডানহাত ছিলেন। সেই সুবাদে অসংখ্য সহিংস ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়া সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। এ কারণেই সেনাবাহিনীতে তার অবাধ নিয়ন্ত্রণ। সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল না বলেই গত বছরের ২১ নভেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মুগাবে। ওই সময় মুগাবে যখন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট নানগাগওয়াকে বরখাস্ত করে স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছিলেন তখনই ক্ষেপে যায় সেনাবাহিনী। তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিয়ে গেলেও নানগাগওয়ার নির্দেশেই জিম্বাবুয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন তিনি। মুগাবের পদত্যাগের পর জনতার উল্লাসে যোগ দেয় সেনাবাহিনীও।

মুগাবের পদত্যাগের পর জনতার আশা ছিল এবার বুঝি কিছুটা পরিবর্তন আসবে দেশটিতে। কিন্তু তা আর হলো না। আবারো জানু-পিএফ পার্টির শাসনই বহাল থাকছে দেশটিতে। একটিমাত্র রাজনৈতিক দল আর কতদিন দেশটির শাসন ক্ষমতায় থাকবে? পার্টির প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট মুগাবে ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৩৭ বছর। ১৯৮০ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। আর ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল এই দীর্ঘ ৩০ বছর রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকতে অনেক কিছুই করেছেন মুগাবে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বৈরতন্ত্র। নিজে হয়েছেন স্বৈরশাসক। আর এর একমাত্র কারণ তার দম্ভ ও অহংকার।

জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কর্ণধার তিনি। মূলত তার কারণেই জিম্বাবুয়ে স্বাধীন হয়েছে। আর এজন্য তাকে লড়তে হয়েছে দীর্ঘদিন। ১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতার ধারাবাহিকতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জানু-পিএফ পার্টি। এরপরের বছরেরই বন্দি করা হয় তাকে। প্রায় দশ বছর রোডেশিয়ার কারাগারে ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৮০ সালে মুগাবের নেতৃত্বে দেশের সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ দেশটিকে স্বাধীন করে। তখন থেকে ক্ষমতায় আসীন দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা রবার্ট মুগাবে। এটাই তার অহংকার। ভাবতেন, দেশের জনগণ সবসময় তার অনুগত থাকবে। তাকে ভালোবাসবে। কিন্তু তার দুঃশাসন যে ধীরে ধীরে জনতার মনে ক্ষোভের সঞ্চার করছে তা বোঝেননি ৯৪ বছর বয়সী মুগাবে। এই আত্মবিশ্বাস আর অহংকারই তার জন্য কাল হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একবার তো তিনি বলেই বসলেন, একমাত্র ঈশ্বরই নাকি তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে।

সেটা ছিল ২০০৮ সাল। দেশটির জাতীয় নির্বাচনের বছর। নির্বাচনের আগে মুগাবে প্রতিশ্রুতি দেন, যদি তিনি নির্বাচনে হারেন তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তিনি যে নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন, তা ভাবেননি মুগাবে। ওই বছরের সেই নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় দফায়। তার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী মরগান টিএস ভাঙ্গারাইয়ের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মুগাবে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বেছে নেন সহিংসতার পথ। দীর্ঘদিনের প্রতিদ্ব›দ্বী মরগানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেন কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদটি আঁকড়ে ধরেই থাকেন তিনি। ২০১৩ সালের নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি। কিন্তু ততদিনে দেশটিতে থাকে না আর শক্তিশালী বিরোধী দল। আগের বারের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নেন তিনি। নির্বাচনে হারতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকেই বিরোধী দল নির্মূলে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। তবে গণভোটে তার প্রথম পরাজয় ২০০০ সালে। সেই সময়ও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করে ব্যাপক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে নির্বাচনে জেতেন তিনি।

মুগাবের শাসনামলে দেশটির সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখল নেয় জানু-পিএফ পার্টি। মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। মোট জনসংখ্যার ৮৯ শতাংশ শিক্ষিত হলেও দেশটিতে বেকারত্বের হার বাড়তে থাকে। মুগাবের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি সেই হার আরও বাড়িয়ে দেয়। দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ডুবতে বসে দেশটির অর্থনীতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও দেশটির প্রধান সমস্যা। এছাড়া ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন স্বৈরশাসক। বয়সের কারণে তৃতীয় স্ত্রী গ্রেস মুগাবের ওপর অনেকটা নির্ভরশীলও হয়ে পড়েন তিনি। ফলে তার সরকার তো বটেই, দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে দুর্নীতি। জনতার বিক্ষোভ বাড়তে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতার হাতবদলই হতে পারতো দেশটিতে পরিবর্তনের একমাত্র উপায়। কিন্তু তা আর হলো না। পশ্চিমা বিশেøষকদের মতে, মুগাবের চেয়েও খারাপ ও উৎপীড়ক শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছেন নানগাগওয়া। এর কিছুটা দৃশ্যমান পেক্ষাপটেও আমরা দেখতে পাই। নির্বাচনে নানগাগওয়াকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলে বিরোধীদের বিক্ষোভ দমনে ব্যাপক সহিংসতায় অন্তত ছয়জন মারা যায়। এমনকি ফলাফল মেনে না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের মঞ্চ থেকে চমিসাকে সরিয়েও দেয় পুলিশ। এছাড়া নানগাগওয়ার মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই সাবেক সেনা জেনারেল ও জানু-পিএফ পার্টির সদস্য। ফলে আসলে দলের এবং দেশের প্রধান ব্যক্তি পরিবর্তন হলেও শাসনব্যবস্থায় খুব একটা পরিবর্তন আশা করছেন না বিশ্লেষকরা। তাই এখন দেখার বিষয়, মুগাবের হাঁটা পথেই তিনিও হাঁটবেন নাকি দুর্নীতি আর দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে নতুন জিম্বাবুয়ে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন?

সুলতানা স্বাতী: সাংবাদিক