আমার যে বেলা গেল নাটকে

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:৫৭ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:০৮

সৈয়দ ঋয়াদ

বাংলা নাটকের জন্য এই সময়টা বেশ আশা জাগানিয়া। তবে টিভি নাটকের সময় যে খুব ভালো যাচ্ছে সেটাও বলা যাবে না। এই মন্দের বাজারেও ঈদ এলে কিছু ভালো টিভি ফিকশনের দেখা মেলে। তাই দর্শক এই সময়টাতে দেশীয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ভরসা রাখেন। সারা বছর না হলেও অন্তত টেলিভিশনগুলো ঈদে দর্শকের কথা মাথায় রাখে। সেই হিসেবে এক ধরনের পরিকল্পনা হয়। উৎসব শেষে কিছু কাজ জায়গা করে নেয় দর্শকের মনে। যেমনটা হয়েছে গত ঈদের ‘বড় ছেলে’ নাটকটি নিয়ে। সারা দেশে যেন ‘বড় ছেলে’ নাটকের কলরব উঠেছিল। কিছু কাজ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ সরব। এবারের ঈদে প্রচার হওয়া কিছু নাটক-টেলিছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ। কমেডির ভিড়ে আর ভাড়ামোতে হারিয়ে যাওয়া টিভি নাটক যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে এই ঈদে। সবাই বলছে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের নাটকের গুণগত মান বেশ ভালো। দর্শকের ভালো লাগায় যে কাজগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তেমন কিছু নাটক উঠে এসেছে ঢাকাটা্ইমসের দর্শক জরিপেও। সেগুলো নিয়ে এই আয়োজন

পাতা ঝরার দিন

বয়সের ভারে আগের মতো কিছুই মনে রাখতে পারেন না...ক, বৃদ্ধ এই বাবা খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের বাসা। সময়মতো বাসায় না ফেরায় তাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন তার বড় মেয়ে। বাবার জন্য তার দুই কন্যার উৎকণ্ঠা ক্রমশই বাড়ে। কিন্তু স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া বাবা ঘরে ফিরতে পারেন না। পিতার ভূমিকায় শক্তিমান অভিনেতা হাসান ইমাম কাঁদিয়েছেন দর্শকদের। শেষ যখন বাবাকে স্টেশনে খুঁজে পেলেন, বাবা তখন অন্য একটি ট্রেনে করে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। আর পাওয়া হয়ে উঠে না বাবাকে। শেষ দৃশ্যটি এক অসহায় বৃদ্ধের নিয়তি। ভাই- ব্রাদার এক্সপ্রেসের আয়োজনে ‘পাতা ঝরার দিন’ নামের এই নাটকটি পরিচালনা করেছেন রেদোয়ান রনি। অনেকদিন পর যেন রেদোয়ান রনিকে নিজস্ব রূপে দেখা গেছে। নাটকের মূল বা কেন্দ্রীয় (বাবা) চরিত্রে অভিনয় করেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, বড় মেয়ের চরিত্রের মধ্য দিয়ে অনেকদিন পর অভিনয়ে ফিরেছেন এক সময়ের জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী ঈশিতা। বিশেষ একটি চরিত্রে মৌসুমী হামিদও বেশ ভালো করেছেন।

গল্প ভাবনা: আদনান আল রাজীব

পরিচালনা: রেদওয়ান রনি

অভিনয়ে: হাসান ইমাম, বন্যা মির্জা, ঈশিতা, মৌসুমী হামিদ

আয়েশা

এবারের ঈদ উৎসবের সবচেয়ে আলোচিত নাটক নিঃসন্দেহে ‘আয়েশা’। আয়েশা নাটকের মধ্য দিয়ে প্রায় ১০ বছর পর টিভি নাটক নির্মাণ করলেন এই খ্যাতিমান নির্মাতা। আনিসুল হকের আলোচিত উপন্যাস ‘আয়শা মঙ্গল’ নাটকে রূপান্তর হয়েছে ‘আয়েশা’ নামে। সত্তর দশকে ঘটে যাওয়া বিমান বাহিনীর এক নির্মম অভ্যুত্থানকে ঘিরে। নিরপরাধ এক কর্পোরালের মার্শাল ল’ অনুযায়ী ফাঁসি হয়ে যায়। তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে কর্পোরাল স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগটুকু দেয় না। মৃত্যুদ-ের পর স্বামীর লাশ নিতে এলেও তার কাছে লাশ দেওয়া হয় না। তাকে জানানো হয় আপনার স্বামীর দাফন হয়ে গেছে।

আয়েশা চিৎকার করে বলেন, ‘জীবিত মানুষটারে দেখতে দিলেন না, মৃত মানুষটারেও দেখতে দিলেন না। এখন কবরটা কই আছে সেইটাও কইতেছেন না স্যার। আমরা কি কবর জেয়ারতও করতে পারমু না? এইটা কোন বিচার গো স্যার।’ স্বজন হারানোর বেদনায় আয়েশা ছুঁয়ে গেছে দর্শকের হৃদয়। আয়েশা চরিত্রে তিশার দুর্দান্ত অভিনয় দর্শক নাটকটি মনে রাখবে অনেকদিন। চঞ্চল চৌধুরীও তার অভিনয়ের যে ভার তা ধরে রেখেছেন। মোট কথা এবারের ঈদের অন্যতম সেরা কাজ হিসেবেই আয়েশা বিবেচিত হবে।

গল্প: আনিসুল হক

পরিচালনা: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

অভিনয়ে: চঞ্চল চৌধুরী, তিশা

আমার নাম মানুষ

আমরা যে মানুষ সেটা বেমালুম ভুলে বসে আছি। হঠাৎই কেউ একজন এসে যেন কানে কানে বলে গেল ‘আরে ভাই আপনি তো মানুষ।’ আচমকা জেগে উঠল কিছু মানুষ। আসলেই তো আমরা তো মানুষ! চারদিকে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি যেসব আমরা রোজ সহ্য করে চলেছি। প্রতিবাদটুকু পর্যন্ত করি না। তাতো হওয়ার কথা ছিল না। এই শহরে কেউ কেউ রুখে দাঁড়ান। প্রতিবাদও করেন। তারাই আসল মানুষ। নির্মাতা শাফায়েত মনসুর রানা হয়তো তাদেরই একজন। এবারের ঈদে শাফায়েত মনসুর রানা নির্মাণ করেছেন ‘আমার নাম মানুষ’ নামে দুর্দান্ত এই টেলিফিল্মটি। নিজেদের চরিত্রে একেকজন অভিনেতা অসাধারণ করেছেন। জন কবিরকে দেখে বিশেষ ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সত্যি অসাধারণ ছিল। শাফায়েত মনসুর রানা, ইরফান সাজ্জাদ ও অপর্ণা ঘোষসহ বাকি সবার চরিত্রেই মন ছুঁয়ে গেছে। নির্মাতা হিসেবে শাফায়েত মনসুর রানাই ব্যতিক্রম যিনি বারবার খুঁজেন আমাদের আসল পরিচয়। তাই দর্শক ভালো লাগার দিক থেকে এটি অসামান্য।

রচনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: শাফায়েত মনসুর রানা

অভিনয়ে: তারিক আনাম খান, জন কবির, অপর্ণা ঘোষ, ফখরুল বাশার মাসুম, মিলি বাশার,

জয়রাজ, ফারিহা শামস সেঁওতি, ইরফান সাজ্জাদ, সুদীপ বিশ্বাস ও শাফায়েত মনসুর রানা

দ্য অরিজিনাল আর্টিস্ট

মোহাম্মদ আলী। একজন মেকআপম্যান। খবর কাগজ মারফত তিনি জানতে পারলেন একটি প্রেস্টিজাস অ্যাওয়ার্ড তিনি পাচ্ছেন। এই মেকআপম্যানের জীবন যেন মুহূর্তেই পাল্টে গেল। সাধারণ থেকে তিনি রীতিমতো হয়ে উঠলেন স্টার। এই নিয়ে মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী দারুণ খুশি। পরে এই মেকআপম্যান আর্টিস্ট জানতে পারলেন পুরস্কারটি তিনি পাচ্ছেন শিল্প নির্দেশনার জন্য। তখনই যেন সব গড়বড় হয়ে গেল। কিন্তু তিনি তো মেকআপম্যান। শিল্প নির্দেশনা পুরস্কারতো তার পাওয়ার কথা নয়। তাই আবেদন করলেন পুরস্কারটি যেন দেওয়া হয় মেকআপম্যান হিসেবে। কিন্তু ঠিক করতে গিয়ে ধরা পড়লো মেকআপম্যান হিসেবেও একজন পুরস্কার পাচ্ছেন। সরকারি দপ্তর তাদের ভুল স্বীকার করতে রাজি নন। তারা চান মোহাম্মদ আলী যেন শিল্প নির্দেশনার জন্যই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। এর জন্য তারা তাকে শাসালেনও। মোহাম্মদ আলী ঠিক করলেন এই পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন। এই নিয়ে এগিয়েছে নাটকটির গল্প। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন কামরুজ্জামান কামু। কামুর স্ত্রীর ভূমিকায় সাধারণ গৃহবধূর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন নাবিলা। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মুকিত জাকারিয়া।

চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: মাহমুদুল ইসলাম

অভিনয়ে: কামরুজ্জামান কামু, মাসুমা রহমান নাবিলা, মুকিত জাকারিয়া

কলুর বলদ

‘কলুর বলদ’ নাটকের জনপ্রিয়তাই এই নাটকের সিক্যুয়াল হিসেবে এবারে ঈদে নির্মাণ হয়েছে ‘কলুর বলদ ২’। নাটকের নাম নিয়ে আপত্তি থাকলেও এই নাটকের গল্পকার ও নাট্যকার মেজবাহ উদ্দিন সুমনের এক অসাধরণ গল্প এটি। পরিবারের ভরণ-পোষণ করার দায়িত্ব নিয়ে প্রিয় মুখ আর প্রিয় মানুষকে ফেলে বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমানো প্রবাসীদের গল্পই এই নাটকের উপজীব্য। আর দিনান্তে নিজের পরিবারের মানুষ কিভাবে বদলে যায়। আপন মানুষ মুহূর্তেই হয়ে যায় পর। তাদের টাকায় গড়া সম্পদে ভাগ বসায় অন্য ভাইবোনেরা। অবশেষে তাদের জন্য কিছুই থাকে না। স্বার্থপরতার এই খেলায় আপন মানুষ কিভাবে বদলে যায় সেই ভাবনা উঠে এসেছে কলুর বলদে। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়ক রিয়াজ, মনপুরা-খ্যাত ফারহানা মিলি ও দিলারা জামান। অসাধারণ এই নাটকের গল্প মন ছুঁয়েছে বাঙালি দর্শকদের।

গল্প: মেজবাহ উদ্দিন সুমন

পরিচালনা: সাজ্জাদ সুমন

অভিনয়ে: রিয়াজ, ফারহানা মিলি, দিলারা জামান

এক কথায় যদি বলি এবারের ঈদে ভালো নাটকের সংখ্যাই বেড়েছে। সেই তালিকাও বেশ বড়। ঈদে দর্শকের মুখে আওয়াজ তুলেছে এমন নাটকের তালিকায় রয়েছে শিহাব শাহীনের রচনা ও পরিচালনায় ‘বিনি সুতোর টান’, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ‘বিথীর বানান ভুল ছিলো’, মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘শোক হোক শক্তি’, আশফাক নিপুণের ‘সোনালী ডানার চিল’ মাবরুর রশীদ বান্নাহ পরিচালিত ‘লালাই’ ও ‘একটু হাসো’, দিপু হাজরার ‘বাঘের মা’, মাহমুদ দিদারের ‘সিনেমা সিনেমা খেলা’সহ আরো বেশ কিছু নাটক। সব মিলিয়ে ঈদের নাটক দর্শকের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। আর ভালো জানান দিয়েছে বাংলা নাটক এখনো ফুরিয়ে যায়নি। শুধু বিশ্বাস, ভালোবাসা আর আস্থায় ফিরে আসতে পারে সোনালি অতীত। সোনালি ডানার চিল হয়ে।