মহররমের তাৎপর্য ও করণীয়

মাওলানা ইউসুফ নূর
 | প্রকাশিত : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৪৭

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের দশম দিনকে আশুরার দিন বলা হয়। আবহমান কাল থেকেই মহররম মাস এক বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সু-প্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না। (সুরা তাওবা: ৩৬)

বিদায় হজের সময় মিনায় প্রদত্ত খুতবায় রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্মানিত মাসগুলোর বর্ণনা দিয়ে বলেন: তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক – জিলকদ, জিলহজ ও মহররম, অপরটি হলো রজব। (মুসলিম) মনীষী ইমাম জাসসাস (রহ.) ‘আহকামুল- কুরআন’গ্রন্থে বলেন, ‘তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের ওপর অবিচার করো না।’

কোরআনের এ বাক্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ মাসগুলোর এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার ফলে এতে ইবাদত করা হলে বছরের বাকি মাসগুলোতেও ইবাদতের তাওফিক ও সাহস লাভ করা যায়। অনুরূপ কেউ এ মাসগুলোতে পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে বছরের বাকি মাসগুলোতেও পাপাচার থেকে দূরে থাকা সহজ হয়। তাই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার থেকে বিরত থাকা হবে অপূরণীয় ক্ষতি।

মহররমের প্রথম দশকে যাবতীয় ইবাদত যথা নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দান-খয়রাত ইত্যাদির সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। বিশেষত এ মাসে রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘রমজানের রোজার পর শ্রেষ্ঠ রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’ (মুসলিম) মহররমের দশম দিবস (আশুরা) অতি পুণ্যময় ও মহিমান্বিত দিন। এদিন রোজা রাখার ফজিলত ও তাকিদ অন্য দিনের চেয়ে বেশি। এটা মহানবী (সা.) এর সুন্নাত।

কেন এই রোজা: ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন ইয়াহুদিদেরকে মহররমের দশম তারিখে রোজা রাখতে দেখেন। রাসুল (সা. ) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এ দিন রোজা রাখ কেন? তারা বলল, এটা আমাদের মুক্তি দিবস। এ দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউনকে তার দলবলসহ সাগরে নিমজ্জিত করেছেন। এর শুকরিয়া হিসেব মুসা (আ.) এ দিনে রোজা রেখেছেন। একই কারণে আমরাও রাখি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমরা তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিকতর আপন ও হকদার। অতঃপর তিনি নিজেও এদিন রোজা রাখেন এবং সবাইকে রোজা রাখার হুকুম দেন।’ (বুখারি, মুসলিম)

আশুরার রোজার ফজিলত: উম্মত জননী হজরত হাফসা (রা.) বলেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা কখনো ছাড়তেন না। (নাসায়ি) আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, আশুরার রোজার দ্বারা তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিজী)

উম্মাহর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা: ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনে রোজা রাখলেন এবং সবাইকে রোজা রাখার আদেশ দিলেন। সাহাবারা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এদিনে ইয়াহুদিরাও রোজা রাখে আর আমরাও রাখি, এতে তাদের সাথে আমাদের সাদৃশ্য হচ্ছে। রাসুল (সা.) বললেন: আগামী বছর পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে নয় তারিখের রোজা ও রাখবো।’ (মুসলিম) ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: মহররমের নবম ও দশম এই দুই দিনে তোমরা রোজা রাখো এবং এই ক্ষেত্রে ইয়াহুদিদের বিপরীত করো। (তিরমিজি)

বর্তমান আশুরা: রোজা রাখার মাধ্যমে আশুরা উদযাপন– এটাই হচ্ছে মহানবী (সা.) এর সুন্নাত। তার মহান সাহাবাদের কর্মপদ্ধতি ও ছিল অনুরূপ। অথচ আজ আমাদের সমাজে আশুরাকে কেন্দ্র করে অনেক বিদাত ও শরিয়তবিরোধী কর্মকাণ্ডের ছড়াছড়ি। অনেক পরিবারে আশুরা উপলক্ষে বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেব (রহ.) বলেন: ‘শরিয়তের অত্যাবশ্যকীয় কাজ মনে করে আশুরার দিবসে মুরগি জবাই করা, কোরমা-পোলাও এবং রকমারি খাবারের আয়োজন করা, আর কেউ না করলে তাকে ভর্ৎসনা করা জায়েজ নয় বরং এসব কাজ বিদয়াত। প্রকাশ থাকে যে, কোনো কোনো কিতাবে খাস আশুরার দিনে চোখে সুরমা লাগালে অনেক ফায়দা এবং গরিব মিসকিনকে খাদ্য ও বস্ত্র দান করলে বিশেষ সাওয়াবের অধিকারী হওয়া যায় বলে যেসব হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। অধিকাংশ হাদিস বিশারদ এসব হাদিসকে অশুদ্ধ ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। অতএব, এসব জাল হাদিসের ওপর আমল করা মোটেও ঠিক নয়।’ (মুহাররম ও আশুরার আহকাম)

অনেকের ধারণা কারবালা ট্রাজেডির কারণেই ইসলামি শরিয়তে আশুরার এত গুরুত্ব। অথচ এ ধারণা ঠিক নয়। কারবালার ঘটনার বহুকাল পূর্বে উপরে বর্ণিত ঘটনা ছাড়াও আরো অনক ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার দিনে ঘটেছে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কারবালার ঘটনা একটি হৃদয়বিদায়ক ঘটনা। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সহ আহলে বাইতের ৭৮ জন সদস্য শাহাদত বরণ করেছেন। কলিজার তপ্ত খুন দ্বারা রচনা করেছেন তারা অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অমর ইতিহাস এবং প্রজ্জলিত করেছেন ইসলামি চেতনার অনির্বাণ মশাল। সমাজের সর্বক্ষেত্রে নববী আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ করাই ছিল শোহাদায়ে কারবালার উদ্দেশ্য। হযরত হোসাইন ও তার সহযোদ্ধারা হচ্ছেন কালিমাহ তায়্যিবাহ তথা তাওহিদি সংগ্রামের চিরন্তন চেতনা ও দুর্নিবার প্রেরণা।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি আজমিরী (রহ.) যথার্থ বলেছেন: প্রকৃত বাদশাহ্ ও অধিপতি হচ্ছেন হোসাইন দ্বীনের প্রতীক ও আশ্রয়স্থল হচ্ছেন হোসাইন শীর দিয়েছেন কিন্তু ইয়াজিদে হননি বিলীন আসলেই ‘লা ইলাহার’স্মিারক হচ্ছেন হোসাইন।

কিন্তু আজ সে দিকটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। বাতিল সম্প্রদায়ের অনুসরণে আশুরাকে ‘কারবালার শোক দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এদিন তাজিয়া মিছিল, শোকগাঁথা বর্ণনা, পুঁথি পাঠ ও শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছে। কোরআন-সুন্নাহ ও সাহাবা কেরামের জীবনাদর্শে এ জাতীয় তৎপরতার কোনো প্রমাণ ও অনুমোদন নেই। এগুলো সম্পূর্ণ বিদাত। ঈমান-আকিদা ও আমল ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য সুন্নাতের অনুসরণ ও বিদাত বর্জন অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর তরে এটাই হচ্ছে মহররমের শাশ্বত আহ্বান। যারা এদিনটিকে নিছক শোক দিবস ভেবে মাতম করে বেড়ায় তাদের উদ্দেশ্যে কবি নজরুলের ভাষায় বলি, ‘ত্যাগ চাই মার্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’

লেখক: ইমাম-খতিব মুবাল্লিগ, ধর্মমন্ত্রণালয়, কাতার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :