নেতিবাচক ঘটনা ও সংবাদে সবার এত আগ্রহ কেন?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:২১

কাকে দোষ দেব? সাংবাদিকদের নাকি সাধারণ মানুষকে? যে কোন নেতিবাচক ঘটনার খবর-অখবর ফেসবুকে দাবানলের মত ছড়ায়, ভাইরাল হয়। কিন্তু দেশের সাফল্য ও অগ্রগতির খবর নিয়ে পোস্ট দেয়া হয় না খুব একটা, ভাইরাল হয় না, মুলধারার গণমাধ্যমও যথাযথ কাভারেজ দেয় না।

সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই। মানুষকে দরকারি সব তথ্য দিয়ে সাবধান করা, অনুপ্রাণিত ও সক্রিয় করার নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব গণমাধ্যমের। মানুষের যেমন বিপদের খবর জানা দরকার, তেমনি সম্ভাবনার খবরও পাওয়া দরকার। মানুষ যেমন সতর্ক হতে চায়, মানুষ তেমনি সমস্যার সমাধানও পেতে চায়। তাহলে গণমাধ্যমে কেন ভালো ঘটনা বড় সংবাদ হবে না?

দুর্নীতির খবর যেমন জানা দরকার, প্রশাসনে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা হওয়ার খবরও আসা দরকার। গণমাধ্যম শুধুমাত্র উদ্বেগ ছড়ানোর মেশিন হতে পারে না। মানুষ সারাক্ষণ হতাশ হয়ে থাকতে চায় না, হতাশ হয়ে থাকলে এগুনো যায়না। মানুষের, রাষ্ট্রের সাফল্য তুলে ধরলে হতাশ মানুষজন আশাবাদী হয়, সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়।

কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম করছে কী? কিছুটা অভ্যাসের জন্য, কিছুটা রাজনৈতিক কারণে, কিছুটা শিক্ষা ও পেশাদারিত্বের অভাবজনিত কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নেতিবাচক সংবাদের প্রতি বেশি মনোযোগী। এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা বিভাগে শেখানো হয়, ‘গুড নিউজ ইজ নো নিউজ’। ভালো সংবাদ কেন সংবাদ হবে না এর কোনো উত্তর দিতে পারেন না এমন নেতিবাচক চর্চা করা শিক্ষক ও সাংবাদিকগণ।

মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের তিন ধাপ এগুনোর সংবাদে না দেখা গেল জনকোলাহল, না দেশের বড় বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো কাভারেজ দিল এই সংবাদের। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার কাভারেজ দেখলাম। পেছনের পাতায় এক কলামের নিউজ ছেপেছে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির। অথচ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের জাতিসংঘের একজন নিচের সারির কর্মকর্তার সাথে বৈঠক এর খবর ছেপেছে খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায়। জাতিসংঘ নাকি বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়! অথচ জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে মিটিং এর ভুয়া খবর ছড়িয়েছিল বিএনপি। জাতির সাথে বিএনপির এই মিথ্যাচারের সংবাদটিও এই পত্রিকার কাছে বড় সংবাদ নয়।

শুক্রবার জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনডিপি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় শিক্ষা, গড় আয়ু, মাথাপিছু আয় ও লিঙ্গ সমতাসহ বিভিন্ন মাপকাঠিতে উন্নতির ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) তিন ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ১৩৬তম। ২০১৭ সালে অবস্থান ছিল ১৩৯তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের আগে আছে কেবল ভারত ও ভুটান। সূচকে সবার ওপরে আছে নরওয়ে। প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয় ও সম্পদের উৎস, বৈষম্য, লৈঙ্গ সমতা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও আর্থিক প্রবাহ, যোগাযোগ, পরিবেশের ভারসাম্য ও জনমিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সূচক তৈরি করেছে ইউএনডিপি।

এসবের মানদণ্ডে এবার বাংলাদেশের এইচডিআই মান দাঁড়িয়েছে ০.৬০৮। গত বছরের সূচকে এই মান ছিল ০.৫৭৯। অর্থাৎ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। এ তালিকায় শীর্ষে থাকা নরওয়ের এইচডিআই মান ০ দশমিক ৯৫৩।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের আগে আছে ভারত ও ভুটান। ভারত ১৩১তম। আগের বছর তাদের অবস্থান ছিল ১৩১তম। আর তাদের এইচডিআই মান ০ দশমিক ৬৪০। আর ভুটানের অবস্থান বাংলাদেশের দু’ধাপ ওপরে। তারা আছে ১৩৪তম স্থানে।

তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান ও নেপাল। পাকিস্তানের অবস্থান ১৫০, তাদের আগে নেপালের অবস্থান ১৪৯তম। দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৯০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মানব উন্নয়ন সূচকে দ্বিগুণ উন্নতি হয়েছে। খুব কম দেশই এই উন্নতি করেছে। দুই হাজার ডলারের কম মাথাপিছু আয় করেও প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়ে অর্জন ভালো বাংলাদে্যেশর। আমাদের গড় আয়ু ৭২ বছর ছাড়িয়েছে। যা ভারত ও পাকিস্তানে ৬৬ বছর। ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজারে ৩৮ এ নেমে এসেছে যা ভারতে ৪৫ এবং পাকিস্তানে ৮১।

লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। এর থেকে মূল বার্তা হলো যে, তুলনামূলক মাথাপিছু কম আয় করেও বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে এগিয়ে গেছে।

মানব উন্নয়ন সূচকে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে নরওয়ের পর রয়েছে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, আইসল্যান্ড, হংকং, সুইডেন, সিঙ্গাপুর এবং নেদারল্যান্ড।

তালিকার শেষের দিকে রয়েছে আফ্রিকার দেশ নাইজার, তারপর যথাক্রমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান, শাদ ও বরুন্ডি।

এমন একটি আশা জাগানিয়া সংবাদ কেন মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়বে না? নিজ দেশের সাফল্যের সংবাদ কে না পড়তে চায়? ক্রিকেট খেলায় সাফল্যের সংবাদ যদি প্রথম পাতায় বড় কাভারেজ পেতে পারে, তাহলে পুরো রাষ্ট্রের একটি অর্জনের সংবাদ কেন বড় কাভারেজ পাবে না? তাহলে এসব পত্রিকা খুলে বসার উদ্দেশ্য কী? শুধু নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে জাতিকে একটি হীনমন্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার মানস থেকে কি এসব সংবাদপত্রের বেঁচে থাকা?

বাংলাদেশের নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে সমস্যা আছে। পুরো জাতি এখনো একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এর জন্য অন্যতম দায়ী পক্ষ হচ্ছে গণমাধ্যম। এমনভাবে নিউজ ফ্রেমিং করা হয় যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকলেই কেবল বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি এই এজেন্ডা নির্ধারণকারীদের কাছে কোন মাইনেই রাখে না। হোক গণতন্ত্র, হোক সমাজতন্ত্র, সব তন্ত্রেই মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিই মূল কথা। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পূজারীগণ জাতির জীবনে ইতোমধ্যে চলে আসা ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে একেবারেই নারাজ। তাই বোধ হয়, বাংলাদেশের উন্নয়নের স্মারক হিসেবে জাতিসংঘের ইউএনডিপির ঘোষণা শীর্ষ পত্রিকার কাছে বড় সংবাদ নয়।

ইউএনডিপির ঘোষণার পর দেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোর কাভারেজ দেখে হতাশ হয়েছি। এমন না যে, সব সংবাদমাধ্যমই সরকার পতনের পাঁয়তারা করতে গিয়ে অবিরাম নেতিবাচক সংবাদ দিয়ে যাচ্ছে। ‘ভালো খবর সংবাদ নয়’-এই বাক্য যেন বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অন্যতম নীতি হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা থেকে শুরু করে চিফ রিপোর্টার, সম্পাদক পর্যন্ত এই নীতি মেনে চলেন। সারা বছর অনেক ভালো ঘটনা ঘটে, কিন্তু সাংবাদিকরা নিউজ খুঁজে পায় না, যখনই কোন মারামারি কিংবা অনশন, ধর্মঘটের ঘটনা ঘটে, তখনই সাংবাদিকরা তৎপর হয়ে উঠে। এভাবেই কোন বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন-সংগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেম-ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্ষণের বিশ্ববিদ্যালয়, নিয়োগ বাণিজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় বলে দেশব্যাপী পরিচিতি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সভা, সেমিনার, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সংবাদমাধ্যমে খুব একটা আসে না। সংবাদদাতারা ইতিবাচক কোন ঘটনার সংবাদ অফিসে পাঠালেও ফেলে রাখা হয়, প্রকাশ করা হয় না খুব একটা।

একটি রাষ্ট্রের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তো চিরাচরিত নেতিবাচক সাংবাদিকতা করেই, সেই সাথে যোগ হয় দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হয়েও বাংলাদেশ পৃথিবীতে মৌলবাদের দেশ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ফ্রেমিং এর জন্য। অন্যদিকে নিজদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো নেতিবাচক সাংবাদিকতার মাধ্যমে প্রজন্মকে হীনমন্য করে দিচ্ছে। গণমাধ্যমকে বুঝতে হবে, সবসময় নেতিবাচক সাংবাদিকতা করলে রাষ্ট্র ও সমাজের অগ্রগতি ব্যহত হয়। মানুষ উৎসাহ, অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম নিজ দেশকে ভালোবাসতে শেখে না। একটু বড় হয়েই বিদেশ চলে যেতে চায়, ভাবে বিদেশ মনে হয় জান্নাত উপহার দেবে তাকে। অথচ নিজ দেশকেই জান্নাতের রুপ দেয়া যায়, যদি সমস্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা যায়।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো নিজ দেশের ইতিবাচক সংবাদ দিয়ে আর, পরদেশের নেতিবাচক সংবাদ দিয়ে পশ্চিমকে সমস্ত ভালো আর পূর্বকে সমস্ত খারাপের আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই বাস্তবতা দূর করতে হলে, দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে ইতিবাচক সাংবাদিকতার দিকে নজর দিতে হবে। দুর্নীতি, অন্যায়,অত্যাচারের নিউজ দেয়ার সাথে সাথে উন্নয়ন, সম্ভাবনা, অগ্রগতি, সাফল্যের সংবাদও দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :