৩২ ধারা মানুষকে অস্থির করে দেবে

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:৫৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

সংসদে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাকে একটি কালো বিধান বলে বলে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশে প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান। তিনি বলেছেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাকে আরও কঠিন করে ৩২ ধারা করা হয়েছে।

এতে করে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চলে যাবে যে কারও বাসায়। আর যখন এভাবে ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হবে, যেখানে-সেখানে তল্লাশি করতে পারবে পুলিশ। আর তা মানুষকে অস্থির করে দেবে।

সোমবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর সংবাদপত্র বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এসব আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই সিনিয়র সাংবাদিক।

অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক মতিউর রহমান চৌধুরী সংসদে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে পীর হাবিবুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যম এটার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আসছে। সতর্ক করেছে সরকারকে। নিজেদের মতামতও দিয়েছে। সম্পাদক পরিষদ থেকে মতামত দেয়া হয়েছে, সাংবাদিক নেতারা দিয়েছেন, সব জায়গায় কথা বলেছেন।

‘কিন্তু দেখা গেছে এই আইন-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব মতামত-প্রতিক্রিয়ার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি কোনো শব্দে, বাক্যে এবং কোনো ধারায়। বরং ওই মতামতগুলো এমনি স্ট্যাপলার মেরে দেওয়ার মতো আলাদা করে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ৫৭-এর জায়গায় ৩২ ধারা এসেছে। ৩২ ধারা তো আরও কঠিন। ৫৭ ধারার বিষয়ে আমি বলেছিলাম, ৫৭টা রশি দিয়ে আমাদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে।’

পীর হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি একটি কথা বারবার বলি, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সংগ্রামে কর্মমুখর বর্ণাঢ্য অতীত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সংগ্রামই বেশি করেছে, রাজপথেই তার বেশি সময় কেটেছে। ক্ষমতার সময় তো খুব ক্ষণস্থায়ী।’

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্ম-উপলব্ধির কথা অনেক সময় তাদের বক্তব্যে আসার কথা স্মরণ করেন পীর হাবিবুর রহমান। কিন্তু এখন তাদের উপলব্ধিতে ঘাটতি পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

পীর হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা মাঝে মাঝেই বলেন বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, পরাজয়ের গ্লানি অনেক দীর্ঘস্থায়ী। বিরোধী দলকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন সময় এ কথা তারা বলেছেন যখন সরকারে গেছেন। কিন্তু এখন ঘটনা হলো কি, তারা এটা উপলব্ধি করতে পারছেন না তাদের ক্ষমতা থেকে একদিন সরতে হতে পারে।

‘আওয়ামী লীগ আজকে ক্ষমতায় আছে, কালকে নাও থাকতে পারে। কিন্তু আইনটা কী করে যাচ্ছে। এই আইন কালো আইন। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। দীর্ঘ ২১টা বছর এটার অপব্যবহারের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। যখন-তখন গ্রেফতার হয়েছেন বিশেষ ক্ষমতা আইনে। আমিও তরুণ বয়সে সেনাশাসনের সময় গ্রেফতার হয়েছি।’

ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে মানুষের সম্ভাব্য বিপদের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক  বলেন, ‘এই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা, এতে করে পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে চলে যাবে বাসায়। ওয়ারেন্টের নজির (বাধ্যবাধকতা) থাকার পরও পুলিশ রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে যখন ব্যবহৃত হয়, তখন যা করে, আর যখন এভাবে ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দেবেন, যখন-তখন তল্লাশি, যেখানে-সেখানে তল্লাশি করতে পারবে। তাহলে তো মানুষকে অস্থির করে দেবে।’

গণমাধ্যমের জন্য এটা (৩২ ধারা) খুবই মারাত্মক হবে বলে মন্তব্য করেন এই সিনিয়র সাংবাদিক। বলেন, ‘যেকোনো কিছু আপনি (মিডিয়ায়) পরিবেশন করতে পারবেন কি না, সেটা প্রশ্নের জায়গা। কোনটা রাষ্ট্রবিরোধী, কোনটা সরকারবিরোধী- এখানে সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। কার চরিত্র হনন হয়ে যাচ্ছে এটা কীভাবে বুঝবেন। একটা সত্য উপস্থাপন করা যাবে না। এমন অনেক ধরনের বাধা।

পীর হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গণমাধ্যমকে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বলে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে তারা। এটা অবশ্যই তাদের কৃতিত্ব, এটা সাধুবাদ পাওয়ার মতো। কিন্তু যদি আবার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেন, তাহলে তো আমার দমটা বন্ধ হয়ে যাবে।

‘আমাকে ভালো খাবার ‍দিলেন, ভালো কাপড়-চোপড় দিলেন। কিন্তু আমাকে বললেন কথা বলা যাবে না, গান গাওয়া যাবে না, শিস বাজানো যাবে না, পাখির ডাক শোনা যাবে না। তখন আমার কাছে মনে হবে মৃত্যু তার চেয়ে উত্তম।’

বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদকের আশঙ্কা, এটা সাইবার অপরাধীদের দমনের নামে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার কালো আইন হিসেবে চিহ্নিত হবে। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে এটা কালো আইন হিসেবে চিহ্নিত।’

তবে এখনো সরকার চাইলে এ নিয়ে ইতিবাচক কিছু করতে পারে বলে মনে করেন পীর হাবিবুর রহমান। ‘স্থায়ী কমিটিতে যাওয়ার পর এটা আবার বিবেচনা করে নিয়ে আসা সম্ভব। সরকার চাইলে এটা সম্ভব। আশা করি সরকার সেটা করবে। সরকারকে এটা ভাবতে হবে- দেশের কর্মোদ্যমী, যারা চিন্তা করেন, লেখেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে।’ বলেন তিনি।

এ সময় সঞ্চালক মতিউর রহমান আলোচকের উদ্দেশে বলেন, সমালোচকরা বলেন আওয়ামী লীগ এখন নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয় না।

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার আসলে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির জায়গা থেকে মনে করুন- আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরে নির্ভর করার মতো ১০ জন নেতার নাম বলুন, যেটা আগে আমরা বলতে পারতাম। এখন হঠাৎ নেতা। কেন্দ্রে, দেশে- সব জায়গায় যেন। তাদের প্রজ্ঞা, ভাবমূর্তির জায়গা এখন উত্তীর্ণ হয়নি।’

‘শান্তিতে বিজয়’ শীর্ষক প্রচারাভিযান নিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ডাকে, তখন আমরা বেহুঁশ হয়ে ছুটে যাই। বিদেশিদের সামনে গেলে আমরা সাধু হয়ে যাই। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। মঈন খান এবং এইচ টি ইমাম সাহেব করমর্দন করেছেন দেখতে কত ভালো লাগছে।’

দুই নেতার এই করমর্দন বাস্তবতার কতটুকু প্রতিফলন তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এই নর্বাহী সম্পাদক। ‘সাধারণত দেখা গেছে, নির্বাচন বা আন্দোলনে সমস্যা দেখা দিলে সরকার সংলাপের কথা বলত, আর বিরোধী দল বর্জন করত। সেখানে আজ দুই বছর ধরে বিরোধী দল আলোচনা চেয়ে আসছে, সরকার সেটা নিরন্তর প্রত্যাখ্যান করছে। সেখানে শান্তির যে সু্বাতাস, সেটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে বাস্তবে। তারা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ভেতরে যে দৃশ্য রচনা করেছে, এটা আসলে নাটকের ভেতরেই রাখা যায়।’

(ঢাকাটাইমস/১৮সেপ্টেম্বর/জিএম/মোআ)