অনুসন্ধান পর্ব-১

পরিচালক নিয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্বে জেরবার জাবির আইআইটি

রাইয়ান বিন আমিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
| আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:১০ | প্রকাশিত : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:৫৬

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে চলছে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দিয়ে। সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের মেয়াদ শেষে পরিচালক নিয়োগ নিয়ে এখন দ্বন্দ্ব-জটিলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি)। গত ৩০ জুলাই থেকে সরাসরি উপাচার্যের তত্তাবধানে চলছে এটি।

পরিচালক নিয়োগ দ্বন্দ্বের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সাবেক এক ভারপ্রাপ্ত পরিচালককে যাতে দ্বিতীয় মেয়াদে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ না দেয়া হয় সে জন্য তার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছেন বিভাগের বেশির ভাগ শিক্ষক।

এই দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ইনস্টিটিউটের সাবেক দুই ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে গবেষণা প্রবন্ধ জালিয়াতি, ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়োগ আটকে রাখাসহ নানা অভিযোগের কথা জানা যায়। সব মিলিয়ে অনেকটা জেরবার জাবির আইআইটি। আর এ জন্য ইনস্টিটিউটের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালকদের ‘স্বেচ্ছাচারী’ মনোভাব দায়ী বলে তথ্য পাওয়া গেছে উপাচার্য বরাবর দেয়া বিভিন্ন অভিযোগ/চিঠি থেকে।

সাবেক এক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবার দাবি করছেন, উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বিষয়গুলো জটিল করে তুলছেন। বর্তমানে তিনি আইআইটির পরিচালকের পদ ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে নিজের কাছে রেখেছেন।

তবে এসব সংকটের দ্রুতই একটি সম্মানজনক সমাধান হবে বলে জানান উপাচার্য। সে জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সর্বশেষ গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন কে এম আক্কাস আলী। তার আগে এই দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারী।

বিভিন্ন চিঠি থেকে জানা যায়, বর্তমান সংকট জটিল আকার ধারণ করে আইআইটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারীকে দ্বিতীয় মেয়াদে পরিচালক নিয়োগ দেয়া-না দেয়া নিয়ে। সম্প্রতি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ায় আইআইটির সংবিধি অনুযায়ী তিনিই পরিচালক হওয়ার কথা। কিন্তু তাকে পরিচালক হিসেবে দেখতে চান না বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক।

আইআইটির সংবিধির ৪.ক(১)-এ বলা হয়েছে, ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক পদমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্য থেকে ৩৬ মাসের (তিন বছর) জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কর্তৃক পর্যায়ক্রমে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে একজন পরিচালক নিয়োজিত হইবেন। ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক না থাকলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে একজন সহযোগী অধ্যাপককে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিয়োগ করা যেতে পারে। ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক না থাকলে সিন্ডিকেট এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বা সম্পর্কযুক্ত বিভাগের একজন অধ্যাপককে অনূর্ধ্ব তিন বছর মেয়াদকালের জন্য ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে নিয়োগদান করতে পারবেন।’

কিন্তু ২০১৬ সালের ২১ মার্চ বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির বিশেষ সভায় সর্বসম্মতিতে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে ৩৬ মাস মেয়াদকালের জন্য পর্যায়ক্রমে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে একজন পূর্ণকালীন পরিচালক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ আইআইটির পূর্ণকালীন পরিচালক নিয়োগের বিধি জাবি অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর ২৬(৫) (একজন সহযোগী অধ্যাপক ডিন পদে আসীন হওয়ার যোগ্য) ও আইবিএ, রিমোট সেন্সিংসহ অন্যান্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিয়োগবিধির (একজন সহযোগী অধ্যাপক পূর্ণকালীন পরিচালকের পদ গ্রহণ করতে পারেন) সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বিধি মোতাবেক এই বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের নিয়মিত সভায় উপস্থাপনের কথা থাকলেও গত তিন বছরে পরিচালনা পর্ষদের ৮টি নিয়মিত সভার একটি সভাও আইআইটির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কে এম আক্কাস আলী আয়োজন করেননি বলে অভিযোগ এই বিভাগের শিক্ষকদের। ফলে বিষয়টি আটকে যায়।

শিক্ষকরা বলছেন, সাবেক দুই পরিচালক নিজেদের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেননি। এমনকি এখনো দিচ্ছেন না। অন্যদিকে কোনো কারণে পরিচালনা পর্ষদের নিয়মিত সভা (ছয় মাস অন্তর) অনুষ্ঠিত না হলে, সভা না হওয়ার কারণ উল্লেখ করে পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে অবহিত করার বিধান থাকলেও তৎকালীন পরিচালক তা করেননি, যা পরিচালনা বিধির ৩.১(ঙ) এবং ৩.১(চ) লঙ্ঘন।

এই বছরের মার্চ মাসে আইআইটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম আইআইটির পরিচালককে এপ্রিলের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের সভা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানান ওই শিক্ষকরা।

এদিকে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণা প্রবন্ধ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি তদন্ত করতে আইআইটির একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন পরিচালক কে এম আককাছ আলী তা কার্যকর করার কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

আর গবেষণা প্রবন্ধ জালিয়াতির ঘটনায় বিভাগের শিক্ষক ড. শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করায় তাকে চাকরিতে স্থায়ী না করে নানাভাবে হয়রানি করছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ফজলুল করিম পাটোয়ারী- এমন অভিযোগ উঠেছে। ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর যোগদান করেন শহিদুল ইসলাম, এখনো তিনি অস্থায়ী হিসেবে কাজ করছেন!

সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কে এম আককাছ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল শিক্ষা পর্ষদের ১২৯তম সভা দুটি সহকারী অধ্যাপক ও তিনটি প্রভাষক পদের অনুমোদন দিলেও তা গোপন রাখেন তিনি। তবে সম্প্রতি বিষয়টি জানার পর তা ইউজিসি থেকে অনুমোদন করিয়ে আনা হয়, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে।

পরিচালনা পর্ষদের সভা আয়োজন করতে না পারা এবং নিয়োগ আটকে রাখার পেছনে উপাচার্যের অসহযোগিতাকে দায়ী করলেন কে এম আককাছ আলী। বলেন, ফজলুল করিম পাটোয়ারীকে চান না উপাচার্য, আবার তার পরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যিনি পাবেন তাকেও দিচ্ছেন না। আর পরিচালনা পর্ষদের সভা আয়োজনের জন্য বেশ কয়েকবার আবেদন করলেও তিনি সাড়া দেননি। ফলে নিয়োগসহ সবকিছু স্থবির হয়ে আছে।

আইআইটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে পরিচালনা পর্ষদের কোনো সভা আয়োজন না করায় বিভাগের কোনো সিলেবাস আপডেট করা সম্ভব হয়নি। এতে পুরনো পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

উপরোক্ত বিষয়গুলো সামনে এনে গত ২৬ জুন বিভাগের নয়জন শিক্ষকের মধ্যে ছয়জন ফজলুল করিম পাটোয়ারীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ না দেয়ার জন্য উপাচার্যের কাছে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন।

ফজলুল করিম পাটোয়ারীর প্রতি অনাস্থার কারণ হিসেবে তারা বেশ কয়েকটি অভিযোগ চিঠিতে তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে, তিনি ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগের অর্থায়নে প্রাপ্ত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবের যন্ত্রপাতির প্রাপ্ত তালিকার হিসাব এখনো একাডেমিক কমিটিকে অবহিত করেননি।

তিনি নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষার খাতা নিয়মিতভাবে জমা না দেয়ায় আইআইটির ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব হয়। এমনকি তিনি সভাপতি থাকাকালীন মাস্টার্সের ফল প্রকাশ ১৮ মাস বিলম্বিত হয়, যা সিন্ডিকেটেও আলোচনা হয়। তিনি সভাপতি থাকাকালীন মাস্টার্সের কোনো থিসিস/প্রজেক্ট রিপোর্ট জাবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এবং আইআইটির সেমিনার লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করেননি। অনুসন্ধানেও বিষয়গুলোর সত্যতা পাওয়া যায় বলে চিঠিতে উলেøখ করা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারীর দাবি, এগুলো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘যদি ধরেও নিই যে, বিদ্যমান বিধি পরিবর্তন হয়েছে, তারপরও তো জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আমারই আসার কথা। কারণ আমি আগে যখন ছিলাম তখন তো ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। ওটা পূর্ণকালীন দায়িত্ব ছিল না। আর এখন পূর্ণকালীন দায়িত্ব পাওয়া আমার অধিকার।’

ফজলুল করিম পাটোয়ারির প্রতি অনাস্থা প্রকাশের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের একাধিক শিক্ষক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারী আবার পরিচালক হলে তা ইনস্টিটিউটের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। এ থেকে রক্ষার জন্য আমরা তার প্রতি অনাস্থা জানিয়েছি।’

(ঢাকাটাইমস/১৯সেপ্টেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন

ববির মেডিকেলে  চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলা, ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

ইউনিভার্সিটি অফ স্কলার্সের বিবিএ ১৫তম ব্যাচের নবীন বরণ অনুষ্ঠিত

এবার কুবির আরেক সহকারী প্রক্টরের পদত্যাগ

গুচ্ছের হাবিপ্রবি কেন্দ্রে তিন ইউনিটে পরীক্ষার্থী ১২৩৪১ জন

জাবি অধ্যাপক তারেক চৌধুরীর গবেষণা জালিয়াতিতে তদন্ত কমিটি

বিএসএমএমইউর ১২৪ শিক্ষক-চিকিৎসক ‘গবেষণা অনুদান’ পেলেন সাড়ে ৪ কোটি টাকা

ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থীর মৃত্যু: তদন্ত কমিটি গঠন

বুয়েটে রাজনীতি: হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার পর আইনি পদক্ষেপের ঘোষণা

মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেওয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :