পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মৃত্যু ও ৬১ লাখ টাকার সহযোগিতা

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:০২ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:২৮

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

দিল্লিতে নালা পরিষ্কার করতে নেমে মৃত এক ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছেলেটি কাঁদছে- অর্থের অভাবে দেহ সৎকার করা যাচ্ছে না- এমন একটি ছবি টুইটারে ভাইরাল হওয়ার পরে ওই পরিবারের জন্য প্রায় ৫১ লাখ রুপি (৬১ লাখ টাকা) চাঁদা জমা তুলে দিয়েছেন টুইটার ব্যবহারকারীরা।

ছবিটি তুলেছিলেন দিল্লির একটি পত্রিকার সাংবাদিক, যিনি পেশাগত কারণেই ওই শ্মশানে গিয়েছিলেন। ওই দৃশ্য তাকে এতটাই নাড়া দেয়, যে পত্রিকায় ছাপা না হওয়া ছবিটি তিনি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

ভারতে নালা বা টয়লেট পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রতিবছর মারা যান একশোরও বেশী মানুষ। যদিও প্রায় ২৫ বছর ধরেই ভারতে নালা বা টয়লেট পরিষ্কারের জন্য কাউকে নিয়োগ করা বেআইনী। তবুও সেই কাজটাই করায় বহু ব্যক্তিমালিকানার বাড়ি অথবা সরকারি দপ্তরগুলো।

দিল্লির ভূগর্ভস্থ পয়:প্রণালী পরিষ্কার করতে নেমেছিলেন ২৭ বছরের অনিল। আগে রিকশা চালাতেন। কিছুটা বেশী রোজগারের আশায় নর্দমার পাঁক পরিষ্কারের কাজ নেন বছর পাঁচেক আগে।

রোজই ওইভাবেই ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে নোংরা, পাঁকের মধ্যে নামেন তিনি একটা দড়ির সাহায্যে। কিন্তু গত শুক্রবার দড়িটা ছিঁড়ে তিনি নীচে পড়ে যান। মারা যান সেখানেই। তার পরিবার দেহ নিয়ে গিয়েছিল শ্মশানে। কিন্তু সৎকারের অর্থ ছিল না। তখনই ওই পরিবারটিকে নিয়ে খবর যোগাড় করতে সেখানে পৌঁছিয়েছিলেন হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার রিপোর্টার শিভ সানি।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘‘এই যারা নর্দমা পরিষ্কারের কাজ করেন, তাদের নিয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু খবর হয়েছে আমাদের কাগজে। সেই সূত্রেই ওই পরিবারটির বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে জানতে পারি যে তারা দেহ নিয়ে শ্মশানে চলে গেছে। আমিও যাই শ্মশানে। পরিবারটিকে কিছু প্রশ্ন করব বলে সবে প্যাড, পেন বের করেছি। হঠাৎ দেখি, একটি বাচ্চা ছেলে মৃতদেহের কাছে গিয়ে মুখ থেকে সাদা চাদরটা সরিয়ে দিল। আর মৃতদেহটার মুখে হাত বোলাতে বোলাতে ‘বাবা, বাবা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠল’’।

সাংবাদিকতার জীবনে অনেক কঠিন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে, কিন্তু এটা দেখে তার নিজের চোখেও জল এসে গিয়েছিল। বেশ কয়েক মিনিট কথা বলতে পারেন নি। তারপরেই মোবাইল দিয়েই কয়েকটা ছবি তোলেন শিভ সানি। পরের দিন কাগজে ওই একটা ছবি তার প্রতিবেদনের সঙ্গে বেরোয়নি কারণ মৃতদেহ আর ছোট ছেলেদের ছবি ছাপা অনুচিত।

কিন্তু তারপরেও সেই দৃশ্যটা সানিকে ভাবাচ্ছিল। তখনই তিনি ছবিটি টুইট করেন গোটা ঘটনা জানিয়ে।

সানি বলেন, ‘একটা বাচ্চা ছেলেকে বাবার মৃতদেহের সামনে ওইভাবে কাঁদতে দেখে বহু মানুষের মনকে নাড়া দেয় সঙ্গে সঙ্গে। অনেকে যোগাযোগ করে সাহায্য দেওয়ার কথা বলতে থাকেন। এদের মধ্যে নামীদামী ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে পাকিস্তান-বাংলাদেশ বা অন্য দেশেরও বহু সাধারণ মানুষ রয়েছেন’।

‘আমি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাঁদা তুলতে শুরুর উদ্যোগ নিই অনলাইনেই। কেউ যেমন ৫০ হাজার রুপি দিয়েছেন, তেমনই অনেকে আছেন যারা ১৫-২০ রুপির বেশী দিতে পারেননি। হয়তো ওইটুকুই তাদের ক্ষমতা। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও আরেকটি পরিবারের বিপদে তারাও এগিয়ে এসেছেন’।

অনিলের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে দিল্লিতেই পাঁচজন মারা গেছেন একই ভাবে। সাফাই কর্মচারীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন বেজওয়াদা উইলসন। তিনি বলেন, ‘অনিল নামের ওই সাফাই কর্মচারীর জন্য বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন, বহু টাকা চাঁদা উঠেছে- খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু যে ছোট ছেলেটিকে কাঁদতে দেখে সবার মন ভিজে উঠেছে, সেরকম কিন্তু শয়ে শয়ে আরও শিশু রয়েছে-- তাদের বাবারাও এইভাবে নোংরা পাঁক পরিষ্কার করতে গিয়েই মারা গেছেন.. সেই বাচ্চাগুলির কেউ শিশুশ্রমিক হয়ে গেছে, কাউকে বাবাদের মতো নদর্মায় নামতে হচ্ছে, অনেককে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে কাজের খোঁজে’।

গত দুই দশকে ১৭৬০ জন মানুষ মারা গেছেন নদর্মার নোংরা বা টয়লেট পরিষ্কার করতে গিয়ে। যদিও সাফাই কর্মচারীদের জন্য যে সাংবিধানিক কমিশন রয়েছে, তারা বিভিন্ন ইংরেজী এবং হিন্দী কাগজ থেকে খবর সংগ্রহ করে বলছে ২০১৭ সাল থেকে ১২৩ জন মানুষ নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা গেছেন।

তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বলছে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশী। তাদের হিসাবে শুধুমাত্র দিল্লিতেই ২০১৬ থেকে ২০১৮- এই দুবছরে ৪২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে। যদিও এই কাজে কোনও মানুষকে নিয়োগ করা ১৯৯৩ সাল থেকেই বেআইনী।

আর শহরাঞ্চলে কর্পোরেশন বা পুরসভাগুলির পয়প্রণালী পরিষ্কার করতে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে তার ভেতরে কোনও মানুষকে নামিয়ে দেওয়া অথবা বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের জন্য কোনও ব্যক্তিকে কাজে লাগানোটাও ২০১৩ সাল থেকে বেআইনী।

কিন্তু ঘটনাচক্রে ভারতের সোশিও-ইকনমিক-কাস্ট সেনসাসে দেখা যাচ্ছে গ্রামীন এলাকায় ১,৮০,০০০ পরিবার আছে, যাদের অন্তত একজন করে সদস্য এই কাজ করেন।

আবার সর্বশেষ জনগণনায় দেখা যাচ্ছে ২১ লক্ষ এমন বাড়ি রয়েছে, যেখান থেকে টয়লটের বর্জ্য সরাসরি উন্মুক্ত নালায় গিয়ে পড়ে অথবা সেইসব বাড়িতে এমন টয়লেট রয়েছে, যেগুলি পরিষ্কারের জন্য কোনও মানুষকেই নিয়োগ করতে হবে।

এতেই বোঝা যাচ্ছে যে কী সংখ্যায় সাফাই কর্মীরা রয়েছেন ভারতে। আর সবক্ষেত্রেই তাদের দৈনিক মজুরীর ভিত্তিকে কাজে লাগানো হয়।

তাই আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে এসব কাজের জন্য নিয়োগ না করা হলেও তাদের দিয়ে কাজ করানো চলছেই বেআইনীভাবেই। আর যেসব নারী-পুরুষ এই কাজে যুক্ত, তারা মূলত বাল্মিকী দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের তপশিলী জাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

যদিও রামায়নের রচয়িতার নাম থেকেই এই গোষ্ঠীর নামকরণ বলে মনে করেন অনেকে, তবে এদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে থাকেন বেশীরভাগ মানুষই। যে বাড়িতে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে যান, সেখানে জল পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয় না অনেক ক্ষেত্রে।

গলা পর্যন্ত পাঁকের মধ্যে নামানোর আগে এদের না দেওয়া হয় কোনও রকম সুরক্ষা সরঞ্জাম, না রয়েছে এদের স্বাস্থ্য নিয়ে কারও চিন্তাভাবনা।

ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে অতি বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে কাউকে নেমে গিয়ে সেখান থেকে বালতিতে করে ময়লা তুলে আনার কাজটা অতি বিপজ্জনক বলেই ধরা হয়। ম্যানহোলে নামার আগে এই সাফাইকর্মীরা একটা দেশলাই কাঠি ফেলে দিয়ে দেখে নেন যে আগুন ধরে যাচ্ছে কী না। আগুন জ্বলে উঠলে তারা বুঝে যান যে বিপজ্জনক গ্যাস রয়েছে। আবার ম্যানহোলের ঢাকনা খুলতে গিয়ে যদি আরশোলা বেরিয়ে আসে, তাহলে এরা ধরে নেন যে গ্যাসের মাত্রা নিশ্চই বিপজ্জনক নয় - তাহলে আরশোলাগুলো জীবিত থাকত না।

ড. আশিস মিত্তল নামের এক চিকিৎসকের দুটো সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সাফাই কর্মচারীদের গড় আয়ু জাতীয় গড় আয়ুর থেকে অন্তত দশ বছর কম। এদের বয়স বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ৬০ ও পেরয় না।

এরা যখন ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে নীচে নামেন, তখন সেখানে মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো গ্যাস মিশে বিষাক্ত করে তোলে এবং বেশীরভাগ মৃত্যু হয় ওই গ্যাস নি:শ্বাসের সঙ্গে শরীরে যাওয়ার সাথে সাথেই।

এই কাজে যন্ত্র ব্যবহার করা শুরু হয়েছে ঠিকই, তবে তা খুবই অপ্রতুল। সেই যন্ত্র কিনতে যত অর্থ ব্যয় হয়, তার তুলনায় সাফাই কর্মচারীদের খুবই কম টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয় এবং কোনও ক্ষেত্রেই কোনওরকম প্রোটেক্টিভ গিয়ার, অর্থাৎ নি:শ্বাস নেওয়ার মুখোশ, গ্যাস চিহ্নিত করার যন্ত্র বা শরীর ঢাকা পোষাক, গামবুট কিছুই দেওয়া হয় না।

উইলসনের বলেন, ‘এত বড় সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সরকার প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় প্রকল্প স্বচ্ছ ভারত মিশনের অধীনে শুধু টয়লেট বানানোর দিকেই নজর দিচ্ছে। কিন্তু সেইসব টয়লেট তো পরিষ্কার করতে হবে নারী সাফাই কর্মচারীদের। এই দিকে কেউই নজর দেয় না। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয় না’।

শিভ সানি বলছিলেন, তিনি ছবিটি টুইট করার পর থেকে দুদিনে এখনও পর্যন্ত ৫১ লক্ষ রুপি চাঁদা উঠেছে।

তিনি ফিরে গিয়েছিলেন পরিবারটির কাছে- ওই মৃত সাফাই কর্মীর স্ত্রী বা তার ১১ বছরের ছেলে আর ৭ এবং ৩ বছরের মেয়ে- কেউই সম্ভবত এখনও বুঝতেই পারে নি কত অর্থ তাদের জন্য জমা হয়েছে!

তবে যে বাচ্চা ছেলেটিকে ছবিতে কাঁদতে দেখা গেছে, সে এখন ভুলে রয়েছে নতুন উপহার পাওয়া একটা সাইকেল নিয়ে। ওদের তিন ভাই বোনের ভবিষ্যতের জন্য, শিক্ষার জন্য ব্যাঙ্কে বেশীরভাগ অর্থই ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়েছে।

আর চাঁদার অর্থ থেকেই এক কামরা বাসাটার বাকি পড়ে থাকা তিনমাসের ভাড়াও মেটানো হয়েছে। সূত্র: বিবিসি

ঢাকাটাইমস/২০সেপ্টেম্বর/একে