হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৫৩

ডা. মো. আবু হানিফ
ফাইল ছবি

ক্যানসার কী? ক্যানসার একটি রোগের নাম যা মানুষকে আতঙ্কিত করে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চায়। এটিকে বলে কর্কট রোগ। কাঁকড়ার মতো যাকে ধরে তাকে ছাড়তে চায় না। কী কারণে এই রোগ হয়? ক্যানসারের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। এর সুপ্ত রহস্য উদঘাটন করার জন্য বিস্তর গবেষণা চলছে।

সাধারণভাবে যা বোঝা যায় তা হলো মানুষের শরীরে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে। প্রতিটি কোষে একটি নিউক্লিয়াস থাকে। এই নিউক্লিয়াস হলো কোষের প্রাণ। কোষে থাকে ২৩ জোড়া ক্রোমজম। এই ক্রোমজমগুলো ডিএনএ দ্বারা গঠিত। প্রতিটি ডিএন এর মধ্যে থাকে অসংখ্য জিন। এই জিনগুলো কোষের বিভিন্ন কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তথা মানুষের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিনগুলো মানুষের দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্টগুলো নির্ধারণ করে।

এই অসংখ্য জিনের মাঝে কিছু কিছু জিন আছে যাদেরকে বলা হয় প্রি ক্যানসার জিন অর্থাৎ তারা যেকোনো সময় ক্যানসার জিনে রূপান্তরিত হতে পারে। আরেক ধরনের জিন আছে যাদেরকে বলা হয় টিউমার সাপ্রেসরজিন। এই জিনগুলো প্রি ক্যানসার জিনকে নিবৃত্ত করে রাখে অথবা একটি ব্যালেন্স অবস্থায় রাখে। ক্যানসার সাপ্রেসর জিন যদি দুর্বল, অকেজো বা ডিলিট হয়ে যায় অথবা ডিএনএতে যদি Îæটি দেখা দেয় তখন প্রি ক্যানসার জিনগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং ক্যানসার জিনে পরিণত হয়।

এই ক্যানসার সেলটি তখন সকল নিয়ম কানুন অমান্য করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে এবং খুব দ্রুত একটি বড়ো টিউমারে পরিণত হয়। মানুষের যেকোনো কোষে যেকোনো সময় ক্যানসার হতে পারে। অর্থাৎ মানুষের ধ্বংসের বীজ তার নিজের মধ্যে বপন করা আছে।

আর কিছু জিন আছে যারা জন্মগতভাবেই খারাপ এবং বংশ পরম্পরায় এই খারাপ জিন ট্রান্সমিট হচ্ছে। ফলে বংশগত ক্যানসারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া ধূমপান, পান, সাদা, জর্দা, গুল, সুপারি, মাদক, ভাইরাস, রেডিয়েশন, বিভিন্ন ক্যামিকেল ক্যানসার তৈরিতে সাহায্য করে এবং জিনের পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে এবং ক্যানসার সৃষ্টি করে। তাছাড়া ওজন বৃদ্ধি, শাকসবজি ও ফলমূলের ঘাটতি, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

এই ক্যানসার সেলগুলো ক্ষ্যাপাটে আচরণ করে। তারা কোষের স্বাভাবিক নিয়মকে মানে না। প্রতিটি সেল নির্দিষ্ট সময় পরে মরে যায় এবং নতুন সেল তৈরি হয়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। ক্যানসার সেল তার স্বাভাবিক মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে এবং অমরত্ব দাবি করে। তারা দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। তাদের বৃদ্ধি জিয়োমেট্রিক প্রগ্রেসনে অর্থাৎ ১ থেকে ২, ২ থেকে ৪, ৪ থেকে ৮ ইত্যাদি। অল্প অক্সিজেনে বাঁচতে পারে। অন্য সেলকে ধ্বংস করতে পারে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রক্তের মাধ্যমে বা লসিকা নালির মাধ্যমে যেতে পারে। তাদেরকে বলে সাইকোপ্যাথ। ক্যানসার সেল রক্তে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে। ক্যানসার সেল নিরন্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিভিন্ন সেলকে বিনষ্ট করে এবং এক সময় মানুষকে মেরে ফেলে।

মানুষের শরীরে ২০০ প্রকার কোষ আছে। ১০০ প্রকার ক্যানসার মানুষকে আক্রমণ করে। ক্যানসার মৃত্যুর দুই নাম্বার কারণ। সারা বিশ্বে প্রতি ছয়জনে একজনের মৃত্যু হয় ক্যানসারে। আই আর সি (আন্তর্জাতিক এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে সারাবিশ্বে নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ছিল ১৪.১ মিলিয়ন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪.২ মিলিয়ন। এই হারে বৃদ্ধি পেলে ২০৩০ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ২১.৭ মিলিয়নে এবং মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ মিলিয়নে।

বাংলাদেশে ক্যানসারের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০১২ সালে গ্রোবক্যান এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় জনসংখ্যা ১৫ কোটি, ২৪ লাখ আটজন। ১২ লাখ ২৭ হাজার নতুন ক্যানসার রোগী এবং ৯১.৩ হাজার ক্যানসারজনিত মৃত্যু। প্রতি বছর ক্যানসারে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা দুই লাখ।

হেডনেক ক্যানসার কী? নাক, সাইনাস, মুখ-গহ্বর, জিহ্বা, শ্বাসনালী, খাদ্য নালীর উপরিভাগ, লাল গ্রন্থির ক্যানসারকে একত্রে বলে হেড নেক ক্যানসার।

ভারতে প্রতি বছর দুই লাখ হেড নেক ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়। সারাবিশ্বের ৫৬.৫ ভাগ হেড নেক ক্যানসার ভারত উপমহাদেশকে ডিল করতে হয়। সাউথ ইস্ট এশিয়াতে হেড নেক ক্যানসার অন্য দেশের চেয়ে বেশি হয়, এর প্রধান কারণ ধূমপান, পান, সাদা জর্দ্দা, সুপারি, গুল, অ্যালকোহল এবং খাদ্যাভাস।

এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো ধূমপান। সিগারেটের ধোঁয়ায় ৪০০০ কেমিক্যাল থাকে, এর মধ্যে ৪৩টি ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান এবং ৪০০ বিষাক্ত পদার্থ। এদের মধ্যে নিকোটিন, কার্বন মনোক্সাইড, ফবমালডিহাইড, হাইড্রোজেনসায়ানাইড আর্সেনিক, এমোনিয়া ও ডিডিটি অন্যতম।

রোগের উপসর্গ: হেড নেকের যে অংশে ক্যানসার হয় সেই অনুযায়ী উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন নাকের ক্যানসার হলে নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, রক্ত বের হয়। শ্বাসনালীতে ক্যানসার হলে শ্বাসে কষ্ট হয় এবং স্বরের পরিবর্তন হয়। জিহ্বায় হলে ব্যথা হয়, খাবারের কষ্ট হয়, ঘা হয়। থাইরয়েড হলে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়। হেড নেক ক্যানসার যেকোনো স্থান থেকে গলায় আসতে পারে এবং গলা ফুলে যায়।

বাংলাদেশে হেড নেক ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ এবং প্রতি বছর ৭০ হাজার নতুন রোগী হেড নেক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হয় প্রায় ৭.৫ হাজার রোগী প্রতিবছর।

হেড নেক ক্যানসারের রোগী দিন দিন বাড়ছে এবং ৬০ শতাংশ রোগী এডভান্স স্টেজে ডাক্তারের নিকট আসছে। বিলম্বে আসার প্রধান কারণ হলো অসচেতনতা, অবহেলা, রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত না থাকা এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। প্রথমে রোগীরা কবিরাজ, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি চিকিৎসা নিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করে। এতে করেও বিলম্ব হয়।

তাছাড়া আমাদের যে পরিমাণ ক্যানসার হাসপাতাল আছে তাতে করে মাত্র ১০-১৫ ভাগ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। বাকি রোগীরা নানা কারণে মারা যায়।

হেড নেক ক্যানসার বিষয়টিও মানুষের কাছে নতুন। এই বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি প্রচার-প্রচারণা নেই। হেড নেক ক্যানসার চিকিৎসার বিষয়ে এখনি মনোযোগ না দিলে এটা ভবিষ্যতে ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করবে।

ক্যানসার হলে রোগীরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গরিব রোগীরই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে তারা নিঃস্ব হয়ে যায়। একদিকে রোগীরা রোজগার করতে পারে না অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য টাকা ব্যয় করতে হয়। ফলে সঠিক চিকিৎসা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এইসব রোগীর জন্য অনেক ক্যানসার হাসপাতাল প্রয়োজন। যাতে তারা স্বল্প ব্যয়ে, বিনা খরচে ভালো চিকিৎসা পেতে পারে। অন্যান্য দেশে এর জন্য One Stop ক্যান্সার সেন্টার আছে। যেখানে রোগীদের সার্জারি, রেডিওথেরাপি, ক্যামোথেরাপি ইত্যাদি সব চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশেও কিছু হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হেড নেক ক্যানসারের প্রধান চিকিৎসা হলো অপারেশন। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসারের জন্য সার্জারিই যথেষ্ট। কিন্তু এডভান্স স্টেজের রোগীদের জন্য অপারেশনের পরে এডজুভেন্ট চিকিৎসা হিসেবে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয়। যাতে করে পরবর্তী সময়ে রোগটি দেখা না দেয়।

অপারেশনের ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে কিছু রোগীর রেডিওথেরাপি দিতে হয়। দেরি হয়ে গেলে রোগ পুনরায় দেখা দেয়। সেটা খুব খারাপ পরিস্থিতি কারণ তখন আর তেমন কিছু করার থাকে না। সেজন্য ক্যানসার চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করলে ভালো সুফল পাওয়া যায় না। কিছু রোগী দেশের বাইরে ক্যানসার চিকিৎসা নিতে যায়। সেখানে দীর্ঘ অপেক্ষার লাইন, যাতায়াত অসুবিধা, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা এবং যথেষ্ট আর্থিক ব্যয় ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। চিকিৎসা নেবার পর বার বার ফলোআপে যেতে পারে না। তখন তারা জটিল সমস্যায় পড়ে যায়। তাছাড়া প্রতিবছর শুধু ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে হেড নেক ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কমপ্রিহেনসিব সেবা প্রদানকারী কোনো ক্যানসার সেন্টার তৈরি হয়নি। হেড নেক ক্যানসার সার্জনের সংখ্যাও খুব কম। হেড নেক ক্যানসার চিকিৎসাটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী। এর সার্জারি জটিল এবং পরিশ্রমের কাজ। যারা ক্যানসারে আক্রান্ত হয় তাদের কষ্টের কোনো শেষ নেই। অথচ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করালে ভালো হবার চান্স ৯৫ ভাগ। যদি স্বল্প ব্যয়ে ভালো চিকিৎসা দেওয়া যায় তবে অনেক রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যেতে পারে। একটি ভালো হেড নেক ক্যানসার সেন্টার তৈরি এখন সময়ের দাবি। এই জন্য প্রয়োজন কিছু ডেডিকেটেড ক্যানসার চিকিৎসকের। যারা ক্যানসার রোগীদের সেবা প্রদানের জন্যে নিবেদিত থাকবেন।

আমাদের হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার সাপোর্ট ফাউণ্ডেশন বিনা পয়সায় অপারেশন, স্বল্প পয়সায় আউটডোর সার্ভিস, ক্যানসার রোগীদের আর্থিক সাহায্য প্রদান, সামাজিক পুনর্বাসন, টিভি, দৈনিক পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে ক্যানসার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজ করছে। এখন আমরা একটি ভালো হেড নেক ক্যানসার হাসপাতাল তৈরির প্রক্রিয়ায় আছি। যেখানে স্বল্প পয়সায় বা বিনা পয়সায় উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা যায়।