সাংবাদিক সোহাগের মধ্যস্থতায় দস্যুমুক্ত হচ্ছে সুন্দরবন

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:৪৬

শেখ আবু হাসান, খুলনা
অভয় দিয়ে দস্যুদের নিয়ে আসার একটি মুহূর্ত

একজন সাহসী সাংবাদিকের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যস্থতার মধ্য দিয়ে দস্যুমুক্ত হতে যাচ্ছে সুন্দরবন। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে দস্যুমুক্ত ঘোষণা হতে যাচ্ছে বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোব। আর তাতে সুন্দরবনকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহকারী লাখ লাখ বনজীবী এবং দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।

বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নেয়া সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সরকারের সাধারণ ক্ষমার নীতি, র‌্যাবের জোরালো উদ্যোগ আর সোহাগের বিশ্বস্ত মধ্যস্থতায় র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ৫৭ জন বনদস্যু। আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন সুন্দরবনে থাকা শেষ ২-৩টি বাহিনীর সদস্যরাও।

সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করতে তাদের সঙ্গে সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ানের মধ্যস্থতার কাজটি সহজ ছিল না। একদিকে অবিশ্বাস আর অনাস্থার দোলাচল। অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকি সব সময় তাড়া করেছে তাকে। অচেনা মানুষ আর অজানা স্থান থেকে ফোন পেয়ে কি দিন কি রাত তাকে ছুটতে হয়েছে সুন্দরবনের গহিন থেকে গহিনে।

সোহাগ দেওয়ান এই মধ্যস্থতায় তার সঙ্গে যুক্ত করেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টি ফোরের টিম আন্ডার কাভারকে। প্রায় ৬ মাসের মধ্যে সুন্দরবনের কুখ্যাত দাদাভাই বাহিনী, হান্নান বাহিনী, আমির আলী বাহিনীসহ ৬টি বাহিনীর মোট ৫৭ জন বনদস্যু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনে। র‌্যাব-৬ এর মাধ্যমে এ কঠিন কাজটি সম্পন্ন করেছেন সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ান।

কীভাবে এটি সম্ভব হলো- জানতে চাইলে সোহাগ দেওয়ান বলেন, ‘কখনো ভাবিনি সুন্দরবনের গহিনে দুর্ধর্ষ বনদস্যুদের মাঝে গিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে পারব। কিন্তু এ নিয়ে কৌতূহল ছিল আমার, যা কখনো পিছু ছাড়েনি। ফলে আমি লেগে থেকেছি। সোর্স খুঁজে বেড়িয়েছি। যোগাযোগের সূত্র সন্ধান করেছি প্রতিনিয়ত।’ এরই মধ্যে কিছু সোর্স ও যোগাযোগ ঘটতে থাকে।

সোহাগের এই প্রচেষ্টার কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাব কীভাবে জানি জানতে পারে। দিনটি ছিল চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি।

র‌্যাব-৬ থেকে সোহাগকে জানানো হয়, সুন্দরবনের বনদস্যু দাদাভাই ওরফে রাজন বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, তার সহযোগিতা চান তারা। সোহাগ বলেন, ‘আমি প্রথমে অবাক হয়ে কথা শুনছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরে রাজি হলাম। তখন বুঝতে পারছিলাম আমার সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ। র‌্যাব-৬ থেকে আরও জানানো হয়, বনদস্যুরা সাংবাদিকের উপস্থিতি ছাড়া আত্মসমর্পণে সাহস পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। আমি  বললাম, হ্যাঁ, আমি পারব, তবে দুই-তিন দিন সময় চাইলাম।’

এরপর সোহাগ নেমে পড়লেন সমঝোতা স্থাপনের কাজে। কীভাবে এই সমঝোতা হলো সেটি সোহাগের ভাষ্যে জানা যাক। তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি নিয়ে প্রথমে কথা বলি র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানির ডিএডি জিয়াউল করিমের সঙ্গে। তিনি আমার পরিচিত। প্রথমবারেই আমার সাহস বাড়িয়ে দিলেন তিনি।  সিনিয়র ডিএডি কামরুল ইসলামও আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার এনায়েত হোসেন মান্নানের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে পর্যায়ক্রমে র‌্যাব-৬ অধিনায়কের সঙ্গে আলোচনা হয়।’

সবাই এই উদ্যোগের জন্য সোহাগকে সাহস জোগান এবং এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সোহাগ বলেন, ‘এরপর যোগাযোগ শুরু করি সুন্দরবনের বনদস্যু দাদাভাই ওরফে রাজন বাহিনীর প্রধান জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজনের সঙ্গে। প্রতিদিন একবার তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হতো নির্দিষ্ট সময়ে।’

গত ২ এপ্রিল সুন্দরবনের গহিনে প্রথমবারের মতো দাদাভাই বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে রওয়ানা হন সাংবাদিক সোহাগ। একটি ট্রলারে করে তিনি প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর পৌঁছান সুন্দরবনের আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে। সঙ্গে ছিলেন সেই সোর্স যিনি তাকে এ কাজে আসার জন্য ফোন করেছিলেন।

‘অবশেষে সুন্দরবনের একটি সরু খালের ভেতর  ট্রলারটি প্রবেশ করানো হয়।’ সোহাগ দেওয়ান বলেন, ‘তখন থেকে আমার মধ্যে ভয় ও নানা আজেবাজে চিন্তা ভর করে।’

আধঘণ্টা পর খালের ভেতরে একটি ছোট ডিঙ্গি নৌকা নজরে আসে সোহাগের। বলেন, ‘মনে হচ্ছিল মাছ ধরা জেলে। সামনে আসতেই বন্দুক হাতে দুজন হাফপ্যান্ট পরিহিত লোক দেখতে পাই। তাদের কোমরে বেল্টওয়ালা ছোট ব্যাগ বাঁধা।’ কাছে এসে তারা সালাম দিল সোহাগকে। তিনি বুঝতে পারেন এরা তার উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের অংশ।

কুশল বিনিময় শেষে ট্রলার ও ডিঙ্গি নৌকায় আরও ১০ মিনিট সামনে এগোনোর পর আরও একটি ট্রলার আসে। তাতেও বেশ কয়েকজন মানুষ। এরপর বেরিয়ে আসেন জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন ওরফে দাদাভাই বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান জাকির হোসেনসহ ১০-১২ জন অস্ত্রধারী।

সেখানে দস্যু বাহিনী আপেল, আঙুর ও বোতলজাত পানি দিয়ে সোহাগদের আপ্যায়ন করে। গহিন বনে কীভাবে এসব পাওয়া সম্ভব জানতে চান সোহাগ। বাহিনী-প্রধান রাজন বলেন, ‘আমরা টাকা পাঠালে শহর থেকে সবকিছু চলে আসে। এক লাখ টাকায় ৪০ হাজার টাকার মালামাল পাই। বাকি ৬০ হাজার টাকা বহনকারীসহ অন্যরা নেয়।’

এরপর শুরু হয় আলোচনা। প্রায় ছয় ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন সোহাগ। দস্যুরা জানান, তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চান।

সুন্দরবন থেকে খুলনায় ফিরে সোহাগ যান র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কমান্ডার এনায়েত হোসেন মান্নানের কাছে। তাকে জানানো হয় সেদিনের আলোচনা বিস্তারিত।

এরপর ৮ এপ্রিল আবার সুন্দরবন যাত্রা করেন সোহাগ দেওয়ান। বনে গিয়ে আমীর আলী ও হান্নান বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে লক্ষ্যে পৌঁছান। সেখান থেকে ফিরে আবার র‌্যাবের সঙ্গে কথা বলেন সোহাগ। জানান, সবাই আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত। স্থানীয় র‌্যাব কর্মকর্তারা সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ২৩ মে দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন ঠিক হয়।

সোহাগ বলেন, ‘তার আগের দিন বেলা ১১টায় রওয়ানা করে দুপুরে আবার সুন্দরবনে পৌঁছাই। তারাও (দস্যু বাহিনী) কিছুটা এগিয়ে আসে। চাঁদপাই রেঞ্জের হারবাড়িয়া এলাকায় তাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়।’

এরপর র‌্যাব-৬ এর একটি নৌযানে করে দস্যুদের অস্ত্রসহ নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘদিনের দস্যুতার জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনের প্রত্যয় নিয়ে খুলনার লবণচরাস্থ র‌্যাব-৬ কার্যালয়ে ২৩ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন ও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে সুন্দরবনের ছয় কুখ্যাত জলদস্যু-বনদস্যু বাহিনীর ৫৭ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় ৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১২৮৪ রাউন্ড গুলি জমা দেয় বনদস্যু বাহিনী।

সোহাগ বলেন, ‘প্রথমে ভয় লাগছিল। আসলে ওদের সঙ্গে কথা বলার পর বুঝলাম, ভয় আসলে তাদের। নানা কারণে তারা সুন্দরবনে যান। এর পেছনেও নানা নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি আছে। তাই চিন্তা করলাম, এদের সহযোগিতা করব।’

র‌্যাব-৬-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার হাসান ইমন আল রাজীব বলেন, সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার জন্য সর্বাত্ম¡ক চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা দস্যুমুক্ত হয়েছে। আসছে অক্টোবরের মধ্যে সুন্দরবনকে পুরোপুরি দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজে সহায়তাকারী সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ান ও নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের টিম আন্ডার কাভারকে ধন্যবাদ জানান র‌্যাব অধিনায়ক।

(ঢাকাটাইমস/২৪সেপ্টেম্বর/মোআ)