জাবি আইআইটি অনুসন্ধান: ২

কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে

রাইয়ান বিন আমিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
| আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:৪২ | প্রকাশিত : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:৪৩

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) বিভাগের সাম্প্রতিক সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা গবেষণা প্রবন্ধ জালিয়াতি। এ অভিযোগ তদন্তে কাজ করছে কমিটি। এ নিয়ে উপাচার্যের মন্তব্য- কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ড. শহিদুল ইসলাম ২০১৪ সালে ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওই সময় ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিইইআইসিটি)’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তার ‘বোস্টিং ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন রিকগনেশন ইউজিং এলডিজিপি- লোকাল ডিসটিঙ্কটিভ গ্রেডিয়েন্ট প্যাটার্ন’ শিরোনামে গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন।

পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর বিভাগের ৩৯তম আবর্তনের ছাত্রী তানজিয়া এ্যানি ও সহকর্মী অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারী তার গবেষণা প্রবন্ধের প্রোগ্রাম কোড নেন। শর্ত ছিল তারা এটা কোথাও ব্যবহার করবেন না, শুধু ফলাফল কীভাবে আসে তা দেখবেন।

কিন্তু শহিদুল ইসলামের অ্যালগরিদম তারা তাদের গবেষণাতে হুবহু ব্যবহার করেন। এমনকি ওই অধ্যাপক ও ছাত্রীর কাছে কোনো প্রোগ্রাম কোডও নেই, যা দিয়ে তারা তাদের গবেষণার ফলাফল আবার বের করতে পারবেন।

২০১৬ সালে অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারী ও তানজিয়া এ্যানি ‘পারফরম্যান্স অ্যানালাইসিস অব সিমিলারিটি কো-ইফিশিয়েন্ট ফিচার ভেক্টর অন ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন রিকগনেশন’ শিরোনামে ‘১২তম ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ভাইব্রেশন প্রবলেমস, আইসিওভিপি ২০১৫’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তাদের গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন।

বিভিন্ন নথির সূত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব সব তথ্য।

এ ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনাটি প্রকাশ হলে আইআইটির একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কে এম আককাছ আলী তা কার্যকর করার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তা ভেস্তে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত তদন্ত কমিটিও তাদের প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়নি। ‘তদন্তকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, দ্রুতই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে’ এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি এই তদন্ত কমিটির প্রধান ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরহাদ হোসেন।

অবশ্য উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, তদন্তকাজ চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধ অনুযায়ী কমিটির সুপারিশ মোতাবেক শাস্তি নির্ধারিত হবে।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করায় ড. শহিদুল ইসলামকে চাকরিতে স্থায়ী না করে তাকে নানাভাবে হয়রানি করছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারী- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অপর অভিযুক্ত তানজিয়া এ্যানি ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে এই বিভাগেই প্রভাষক (অস্থায়ী) পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। বর্তমানে তিনি পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। এ ছাড়া এ্যানির বিরুদ্ধে শহিদুল ইসলামের আরেকটি গবেষণা প্রবন্ধ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণায় যেসব মিল

গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহিদুল ইসলামের ‘ইন্ট্রোডাকশন’ অংশের ১ম ছয় ধাপের সাথে ফজলুল করিম পাটোয়ারী ও তানজিয়া এ্যানির ‘ইন্ট্রোডাকশন’ অংশের ১ম ভাগের ২০ লাইন, ৭ম ধাপের ৩-৭ লাইনের সাথে ২১-২৪ লাইন, ৮ম ধাপের ১-২ ও ৬-৮ লাইনের সাথে ২৪-২৬ লাইন, ৯ম ধাপের ২-৪ লাইনের সাথে ২৬-২৭ লাইন এবং ১০ম ধাপের ১-৬ লাইনের সাথে ২য় ভাগের ১-৪ লাইনের হুবহু মিল রয়েছে।

পাটোয়ারি ও এ্যানির ‘সিস্টেম ইমপ্লিমেন্টেশন’ অংশের ১ম লাইনে ফিগার-১ এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের পুরো গবেষণাপত্রের কোথাও ফিগার-১ নামে কিছু পাওয়া যায়নি। কিন্তু শহিদুল ইসলামের ‘প্রপোসড ফিচার রিপ্রেজেন্টেশন মেথডোলজি’ অংশে ফিগার-১ আছে। দেখা যাচ্ছে, তারা এখানে শহিদুল ইসলামের ফিগার-১ এর টার্ম (ধ১, ধ২, ধ৩, ধ৪, ন১, ন২, ন৩ ধহফ ন৪) ব্যবহার করেছেন এবং ব্যাখ্যাও হুবহু কপি করেছেন। কিন্তু এই টার্মগুলোর কোনো প্রয়োগ তারা দেখাননি।

এই অংশেই শহিদুল ইসলামের টেবিল-১ ও ফিগার-৩ এর সাথে পাটোয়ারী ও এ্যানির টেবিল-১ ও এর শিরোনামের হুবহু মিল রয়েছে। শহিদুল ইসলামের ‘এক্সপেরিমেন্টস অ্যান্ড রেজাল্ট অ্যানালাইসিস’ অংশের ৩য় ধাপের সাথে পাটোয়ারী ও এ্যানির ‘৩.২ ক্রস ভ্যালিডেশন পারফরম্যান্স’ অংশটির মিল পাওয়া গেছে।

টেবিল-৫-এ ফজলুল করিম পাটোয়ারী ও তানজিয়া এ্যানি যে ‘কনফিউশন ম্যাট্রিক্স’ তাদের ম্যাটল্যাব প্রোগ্রাম থেকে পেয়েছেন, তার সাথে তাদের উল্লেখিত ফলাফলের কোনো মিল নেই। ‘কনফিউশন ম্যাট্রিক্স’ অনুযায়ী তাদের গবেষণার ফলাফল হওয়ার কথা ৯৭.১১%। কিন্তু তারা ফলাফল উল্লেখ করেছেন ৯৩.৫০%। এই টেবিলেই তারা ‘ফেয়ার’ ৯০.৪% এবং ‘হ্যাপি’ ৯.৬% দেখালেও পরক্ষণেই ‘হ্যাপি’র সাথে ‘ফেয়ার’-এর স্বীকৃতি ০.০ দেখিয়েছেন।

টেবিল-৮ এ ‘অ্যাংগ্রি’ ও ‘স্যাড’-এর সম্পর্ক মিসক্লাসিফাইড হিসেবে দেখালেও টেবিল-৫-এ ‘অ্যাংগ্রি’ ১০০% এবং ‘স্যাড’ ০.০ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া শহিদুল ইসলামের টেবিল-ওওও-এর সাথে তাদের টেবিল-৬ এর একটি অংশ (স্যাড-৮৫.১) ছাড়া বাকি সবগুলো মিল রয়েছে।

পাটোয়ারী ও এ্যানি পুরো গবেষণার কিছু জায়গায় শব্দ পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এতে হুবহু কপি বোঝা না গেলেও মূলভাব একই আছে।

‘রেফারেন্স’ অংশে দেখা যায়, দুটি গবেষণাতেই ৩০টি তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র চারটি (৬, ৭, ২৮ ও ৩০) ছাড়া আর বাকি ২৬টি শহিদুল ইসলামের সাথে মিল রয়েছে।

অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, জালিয়াতির বিষয়টি জানার পর ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ড. শহিদুল ইসলাম আইসিওভিপি ২০১৫-কনফারেন্স অরগানাইজিং মেম্বারদের কাছে অভিযোগ করেন বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। কিছুদিন পর সংস্থাটি ৬০% কপি হয়েছে জানিয়ে একটি মেইল করেন এবং লেখক দুজন তার নামটি তাদের পেপারে সংযুক্ত করতে চান।

এদিকে ফজলুল করিম পাটোয়ারী নিজ উদ্যোগে শহিদুল ইসলামকে ডেকে তার নাম সংযুক্ত করতে চান। কিন্তু তাতে রাজি হননি তিনি।

২০১৭ সালের মার্চে সংস্থাটি চূড়ান্ত ফলাফল জানিয়ে শহিহুল ইসলামকে মেইল করে। তাতে বলা হয়, ‘এটি একটি কনফারেন্স পেপার মাত্র। তাই রচনা চুরির বিষয়টি গভীরভাবে নেওয়া উচিত নয়। লেখকদ্বয় তাদের গবেষণায় আপনার গবেষণা তলব করেছেন, এতে আপনার খুশি হওয়া উচিত। কারণ তারা আপনার গবেষণা অন্য ধরনের উদাহরণ দিয়ে সম্প্রসারিত করেছেন। ’

সংস্থাটি আরও জানায়, ‘তারা লেখা হুবহু কপি না করে প্রতিটি বাক্য একটু পরিবর্তন করে দিয়েছে। যা দেখতে একই রকম হলেও কিছুটা ভিন্নতা আছে।’ কিন্তু সংস্থাটি টেবিল-এর ফলাফল চুরির বিষয়ে কোনো কিছু বলেনি।

অভিযুক্তরা যা বললেন

অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারীর কাছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি তদন্তাধীন বলে কিছু বলতে রাজি হননি। বরং তিনিও অভিযোগ দিয়ে রেখেছেন বলে জানান।

‘চক্রান্তকারীদের’ ফাঁদে পা না দিয়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ফজলুল করিম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রিপোর্টে যদি আমি দোষী হই তাহলে সংবাদের রসদ অনেক ভালো হবে। আর নির্দোষ হলে তখন আমার অভিযোগ আমি সবার সামনে বলব। ’ অপর অভিযুক্ত তানজিয়া এ্যানি তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গবেষাণার প্রথম অংশ দেখতে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় অংশ দেখতে এখানে ক্লিক করুন

(ঢাকাটাইমস/২৩সেপ্টেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :