সাংবাদিকদের বন্ধু লেখক শেখ হাসিনা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:১৩ | প্রকাশিত : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:০৫

বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক ছিলেন। ইত্তেহাদ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয় তাঁর। ইতিহাসের অমূল্য ভাষ্য অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন- ‘মানিক ভাই তখন কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজের সেক্রেটারি ছিলেন। আমাদের টাকা-পয়সার খুবই প্রয়োজন, কে দেবে? বাড়ি থেকে লেখাপড়ার খরচ কোনোমতে আনতে পারি কিন্তু রাজনীতি করার টাকা কোথায় পাব? আমার একটু সচ্ছল অবস্থা ছিল, কারণ আমি ইত্তেহাদ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলাম। মাসে প্রায় তিনশ টাকা পেতাম। আমার কাজ ছিল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করা আর ইত্তেহাদ কাগজ যাতে চলে এবং নতুন এজেন্ট বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ করা যায় সেটা দেখা।’

জীবনের নানা বাঁকে সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক এত ব্যস্ততার মধ্যেও সাংবাদিকদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় যোগাযোগ-সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদপত্রের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। মুক্তিযুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্ত এসব সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কল্যাণে ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। চাকরিচ্যুতদের সরকারি চাকরি দিয়েছেন। সরকারি চাকরির মর্যাদায় রাষ্ট্রীয় ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। বেশ ভালোই চলছিল সব। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর আবারও অশনি ছায়া নেমে আসে সংবাদপত্র জগতে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর সেই স্বাধীনতা আবারও ফিরে পেতে শুরু করে সংবাদপত্র। বাবার দেখানো পথেই হাঁটছেন তিনি। শতব্যস্ততার মাঝেও সংবাদপত্র, সাংবাদিকদের কথা ভাবেন। এখনো তাঁর দিন শুরু হয় এক কাপ চা আর সংবাদপত্র হাতে।

গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সকালে এক কাপ চা ও একটি পত্রিকা যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ! টেলিভিশন বন্ধ রেখে সকালে পত্রিকা নিয়ে বসি।’

একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়কের সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধু-তনয়ার মধ্যে। সংবাদপত্র যে একটি জাতি ও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, তা তিনি মনে করেন। সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রেখে তিনি দেশটাকে দেখতে পান। দুর্গম অঞ্চলের মানুষের সমস্যা-সম্ভাবনার কথা জানতে পারেন। ১৬ কোটির বেশি মানুষের এই দেশটার কত কিছুই তো অজানা থাকে! সংবাদপত্রের পাতা থেকে তিনি এসব অজানাকে জানার চেষ্টা করেন। মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ, কী করলে মানুষের ভালো হবে, কল্যাণ হবে-তা নিয়ে চিন্তা করেন। তাই প্রতিদিন সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়েই কাজ শেষ করেন না। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন ব্যবস্থা নিতে। বলছিলেন- ‘সব পত্রিকা যে পক্ষে লেখে তা নয়। প্রয়োজনীয় সংবাদগুলো মার্ক করি। সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে বলি। সংবাদপত্র থেকে অনেক তথ্য পাই। দুর্গম জায়গার অনেক তথ্যও সংবাদপত্রে আসে। তাতে আমরা সহযোগিতা পাই। এজন্য সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’

নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন সদস্য ভাবেন শেখ হাসিনা। বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতা করেছিলেন। সেই থেকে বাবার আদর্শ সন্তান হিসেবে সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সম্মান। রাজনীতির মাঠে আন্দোলন-সংগ্রামের সময়েও সংবাদপত্র পরিবারের সঙ্গেই সময় দিয়েছেন তিনি। সেই স্মৃতিচারণও করেছেন। ‘আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে নিয়মিত প্রেসক্লাবে যেতাম। আড্ডা দিতাম, চা-পুরি, শিঙারা খেতাম। আমি আপনাদের বাইরের কেউ নই। আমাকেও আপনাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গণ্য করবেন।’

বঙ্গবন্ধু পরিবারের যোগ্য এই উত্তরসূরির মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। একেবারে সাদামাটা একজন মানুষ। জীবনযাপনও সাধারণ। মানুষকে সহজে কাছে টানতে পারেন। আপন করে নিতে পারেন সহসা। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের বহুবার বলতে শুনেছি তাঁর গুণের কথা। বিদেশে তাঁর সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সবসময়ই খোঁজখবর রাখেন তিনি। তারা খেলো কি না, থাকার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না -এসব বিষয় নিজেই তদারকি করেন।

রাষ্ট্রীয় শতব্যস্ততার মাঝেও শেখ হাসিনা সাহিত্যমনা একজন মানুষ। পড়ুয়াও বটেন। সময় পেলেই পড়াশোনা করেন। লেখালেখি করেন। রাজনীতির দুঃসময়ে আন্দোলনের মাঠে সরব থাকার পাশাপাশি পত্রিকার পাতাতেও নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। একের পর এক রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন, যা পড়লে সহজে অনুমেয় হয়, কতটা আবেগ-ভালোবাসা সঞ্চিত তাঁর হৃদয়ে, এ দেশের মানুষের জন্য। এই দেশের জন্য। একটা সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। ওই লড়াইয়ে সাংবাদিকদের পাশাপাশি তিনি একজন কলম সৈনিকও বটেন।

কী অসাধারণ তাঁর রচনা! সাবলীল আর সুনিপুণ বর্ণনা। গল্প-উপন্যাস না হলেও সাহিত্যের বিচারে এসব রচনা পিছিয়ে নেই মোটেও। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। যে কারণে সাহিত্যের রস তাঁর অস্তিত্বের মর্মজুড়ে ছড়িয়ে আছে।

১৯৮৯ সালে শেখ হাসিনার প্রথম বই ‘ওরা টোকাই কেন’। বইটিতে ছয়টি প্রবন্ধ ছিল। প্রথম প্রবন্ধ ‘স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ার’-এর শুরুতে তিনি লিখেছেন- ‘গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামখানি এক সময় মধুমতি নদীর তীরে ছিল। বর্তমানে মধুমতি বেশ দূরে সরে গেছে। তারই শাখা হিসেবে পরিচিত বাইগার নদী এখন টুঙ্গীপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে কুলকুল ছন্দে ঢেউ তুলে বয়ে চলেছে। রোদ ছড়ালে বা জ্যোৎস্না ঝরলে সে নদীর পানি রুপোর মতো ঝিকমিক করে।’ অনবদ্য এক শুরু!

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা তিনি বহু আগে থেকেই বুকে লালন করেন। এই প্রবন্ধটিতে লিখেছেন সে কথা। কীভাবে অনুভব করেন গ্রামকে। কতটা প্রয়োজন মনে করেন গ্রামীণ উন্নয়ন। লেখালেখির শুরুর সময়টা ছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ সময়। ওই সময়ই নিজের লেখালেখিতে বারবার তুলে এনেছেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা। উন্নয়নশীল দেশ গড়তে এই জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনতে হবে- দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মনে। শুরুর এই প্রবন্ধে লিখেছেন-

‘গ্রামের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বলতে আমি কোনো ছিটেফোঁটা বা সাময়িক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নই। যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা পশ্চাৎপদ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত প্রাচীন কৃষি-ব্যবস্থার প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সামগ্রিক সংস্কার করে আধুনিক গ্রাম গড়ে তুলতে হবে। আমি কোনো অনুদানমূলক বা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ উন্নয়ন নয়, ‘টোটাল’ বা ‘সামগ্রিক’ উন্নয়ন চাই। এজন্য প্রয়োজনবোধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষিত-সচেতন তরুণ সমাজকে কাজে নামাতে হবে।’

শেখ হাসিনা একজন মমতাময়ী মা। সেই সঙ্গে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় কঠোর নেতৃত্ব-গুণের অধিকারিণী। আন্তর্জাতিক মহলে বারবার এজন্য প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। অনন্য দৃষ্টান্ত হয়েছেন বিশ^ নেতৃত্বে।

তিন তিনবারের নির্বাচিত এই রাষ্ট্রনায়ক জনগণের চাওয়া-পাওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেকোনো দুর্যোগ বা প্রতিকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। যেকোনো ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাঁর মতো সিদ্ধহস্ত নেতৃত্ব অতীতে ছিল না বললেই চলে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার দাবির প্রতি সম্মান রেখেছেন তিনি। কমিটি করে দিয়েছিলেন। সেই কমিশন বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাই করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোনো কোটা পদ্ধতি না রাখার সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনটি তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছেন। এখন শুধু সুপারিশ অনুমোদনের পর প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষা।

শোনা যাচ্ছে, চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনায় রয়েছে। হয়তো অচিরেই এই ঘোষণাটিও আসবে।

মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এতদিন পিছিয়ে ছিল কওমি মাদরাসা। এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম নয়। সবাইকে একসঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে চান শেখ হাসিনা। তাই তো মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অন্যান্য সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মতো কওমি মাদরাসায় পড়ুয়ারাও সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ পাবেন। সময়োপযোগী এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের আলেম সমাজ আজ শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। অতীতে তাদের এভাবে কোনো রাষ্ট্রনায়ক ভাবেননি। তাই অন্যদের সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তুলনামূলক তফাতটাও তাদের কাছে সহজে অনুমেয়।

নেতৃত্বের গুণাবলী বিচারে বঙ্গবন্ধুর পর প্রজ্ঞা, মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের নাম শেখ হাসিনা। শেখ মুজিবকে হারিয়ে নিরাশার দোলাচলে থাকা এই জাতিকে এগিয়ে নিয়েছেন তিনি। স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া বাঙালির চোখে স্বপ্ন ফিরিয়ে দিয়েছেন। সম্ভাবনার দ্বীপ জে¦লেছেন বুকে, যা কখনো কল্পনাতেও ছিল না- এমন সব উন্নয়ন কাজ আজ বাস্তবায়নের পথে। সবই হয়েছে তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক দর্শন আর অটল মনোবলের কারণে। এ কথা তিনি নিজেও বলেন। এই তো সেদিন সাংবাদিকদের সামনেই আক্ষেপ করে বললেন, সংবাদপত্রের সহযোগিতা তিনি কখনো সেভাবে পাননি। যদিও কে কী লিখল তা নিয়ে তিনি ভাবেন না। তিনি কাজ করেন আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে।

দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি কখনো নিজের অর্জনের কথা চিন্তা করেন না। কী করতে পারলেন সেটাই বিবেচনা করেন।

তাঁর ভাষায়-‘মাঝে মাঝে চিন্তা করি এত পরিশ্রম করি, এতে লাভ কী। মূলত লাভের চিন্তা করি না। কী দিতে পারলাম, কী পরিবর্তন আনতে পারলাম সেটাই বিবেচ্য বিষয়।’ মননে নির্লোভ শেখ হাসিনা এ কারণেই এগিয়ে আছেন। বিকল্পহীন নেতৃত্বের মুকুট তাঁকেই মানায়।

লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক ঢাকাটাইমস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :