বিশ্ব হার্ট দিবসে সচেতনতা
‘মাই হার্ট, ইউর হার্ট’ অর্থাৎ ‘আমার হার্ট, তোমার হাট’- এটা হলো এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান। এ স্লোগানের অন্তর্নিহিত বিষয় হল সব সমমনা মানুষকে একীভূত করা ও হার্টের সুস্থতা বিষয়ে একতাবদ্ধ হওয়া। বিশ্বব্যাপী হৃদরোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য এ দিবসটি পালন করা হয়। আজ বিশ্ব হার্ট দিবস।
হৃৎপিন্ড হলো মানুষের শরীরের একমাত্র অঙ্গ, যেটা আমাদের সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রাখে। কেননা মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যু হলেও আমরা তাকে জীবিত বলতে পারি যতক্ষণ পর্যন্ত হৃৎপি-ের কার্য ক্ষমতা সচল থাকবে। বর্তমানে, মানুষে মৃত্যুর যত কারণ আছে, হৃৎপি- ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে মৃত্যু হলো সবচেয়ে বেশি।
এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০০০ সালের শুরু থেকে প্রতিবছর ১৭ মিলিয়ন লোক মারা যায় এই হৃৎপি- ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে। দেখা যায়, হৃৎপি-ে রক্তনালির ও মস্তিষ্কের স্ট্র্রোক জনিত কারণে মৃত্যুর হার ক্যান্সার, এইচআইভি-এইডস্ এবং ম্যালেরিয়া থেকেও বেশি। বর্তমানে ৩১% মৃত্যুর কারণ ধরা হয় এই হৃদরোগ ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে এবং অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০% কারণও এ হৃদরোগকে দায়ী করা হয়।
হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো এনজাইনা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত হৃৎস্পন্দন হওয়া ইত্যাদি। এনজাইনা হচ্ছে, রোগীর সাধারণত বুকে ব্যথা, বুকে চাপ অনুভব করা, বুক ভার ভার হওয়া, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি। কারো করোনারি আর্টারী বা হার্টের রক্তনালির ৭০ শতাংশ ব্লক হয়ে গেলে তখনই এনজাইনা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এনজাইনা থেকে র্হ্টা অ্যাটাক হয়। আবার করোনারি ধমনি যখন ১০০ শতাংশ ব্লক হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের ফলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।কারা আক্রান্ত হয়
হার্ট অ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে। এটি সাধারণত বয়স্কদের রোগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষের এটি হয়ে থাকে। আমাদের এদেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের এটি হয়ে থাকে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে আমাদের দেশের লোকের ১০ বছর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এখন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, এমনকি ২৫-৩০ বছর বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হলো- স্বাস্থ্য সম্মত খাবার না খাওয়া, ধুমপান ও তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করা ও অ্যালকোহল পান করা।
এ ছাড়া এ অঞ্চলে দুর্বল হার্ট বা কার্ডিওমায়োপ্যাথি একটি পরিচিত হৃদরোগ যেখানে হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বাতজ্বর জনিত হৃদরোগ বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা। সাধারণত ছোটবেলায় বাতজ্বর থেকে পরবর্তীতে বাতজ্বর জনিত হৃদরোগ হয়ে থাকে। বাতজ্বর জনিত রোগে সাধারণত হার্টের ভাল্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর মধ্যে কিছু রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব। আর কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। যদি সময়মতো চিকিৎসা করা না হয় তাহলে পরবর্তীতে শৈল্য চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হতে পারে।
হৃদরোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে যদি কারো পরিবারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শিশুর জন্মগত হৃদরোগ থাকে, হবে সেক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের কিছুই করার থাকে না।জন্মগত হৃদরোগ জন্মগত কারণে শিশুদের হৃৎপি-ের দুটি প্রধান ত্রুটি, যেমন- ভেন্ট্রিকালার সেপ্টাল ডিফেক্ট (ঠঝউ), এট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (অঝউ) সাধারণত আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। সহজ কথায়, হৃৎপি-ের মধ্যে চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয়। ডান ও বাম অলিন্দ একটি পর্দা দ্বারা পৃথক থাকে এবং ডান ও বাম নিলয়ও আরোও একটি পর্দা দ্বারা পৃথক। যদি দুই অলিন্দের মাঝখানের পর্দার কোন ছিদ্র থাকে তাকে এএসডি(অঝউ) বলে আর যদি দুটি নিলয়ের মাঝখানে পর্দার মাঝে কোন ছিদ্র থাকে, তখন তাকে ভিএসডি(ঠঝউ) বলে। এ সমস্যায় অ∙িজেনযুক্ত রক্ত কার্বণ ডাই অ∙াইডযুক্ত রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। সাধারণত শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
চলতে হবে নিয়ম মেনে
হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন- স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। হৃদরোগ প্রতিরোধে কায়িক পরিশ্রম করা, হাঁটাহাঁটি করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা, ধূমপান না করা ও খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবস পালনের উদ্দেশ্যে আমাদের হার্টের যত্ম নেওয়ার জন্য কয়েকটা বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। সেগুলো হলো আপনার হার্টকে জানুন, হার্টকে শক্তিশালী করুন ও হার্টকে ভালোবাসুন। যখন আপনার হার্টের অসুখ থাকবে, তখন সবকিছুতে নিজেকে ক্লান্ত মনে হবে। আপনি ক্রমাগত বৃদ্ধ হতে থাকবেন। আপনি হয়ে যাবেন অনুভূতিহীন। তাই নিকোলাই লেনিনের ভাষায় বলতে হয় “The most important thing in illness is never to lose heart” অর্থাৎ শত অসুস্থতার মধ্যেও যাতে আমরা হৃদয় হারা না হই।
২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হলো অসংক্রামক ব্যাধি জনিত মৃত্যুর হার হ্রাস করা এবং অল্প বয়সে হৃদরোগ জনিত কারণে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। তাই বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে হৃদরোগ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা এবং আমার, আপনার হার্টের সুস্থতা ধরে রাখা। কেননা, হার্টের প্রতিটা স্পন্দনই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
{সূত্র: বিএসএমএমইউ)(ঢাকাটাইমস/২৯সেপ্টেম্বর/এএ/মোআ)