মাশরাফি বাহিনী বদলে দিচ্ছে উপমহাদেশের ক্রিকেট রাজনীতি

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:১১ | প্রকাশিত : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৪১

এশিয়া কাপ জিততে না পারার কষ্ট আছে সত্যি, কিন্তু মাশরাফি বাহিনী যে কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর, বিশেষ করে ১৬ কোটি বাংলাদেশির হৃদয় জিতে নিয়েছে সেটি এখন বলাই বাহুল্য। অনেক সময় জয়টাই মুখ্য হয়ে উঠে না, লড়াইটাই মুখ্য হয়ে উঠে। ঠিক যেমন ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে রঙিন দুবাই শহরে অনুষ্ঠিত এশিয়ার কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য লড়াই জন্ম দিয়ে পুরো বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের সব ক্রিকেটপ্রেমীদের শিহরণমুখর উপহার দিয়েছে টাইগার ক্রিকেটারগণ। ক্রিকেট ইতিহাসে মাশরাফি বাহিনীর এই মরণপণ প্রয়াস এক ধ্রুপদী লড়াই হিসেবে লেখা থাকবে।

পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে, বাংলাদেশ ভারতের কাছে তিন উইকেটে পরাজিত হয়ে এশিয়া কাপ জিততে ব্যর্থ হয়েছে। পরিসংখ্যান সবসময় পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরে না। পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে জীবনের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করা বাংলাদেশ এর ব্যাটসম্যান লিটন দাসকে বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তে আউট দিয়েছিলেন থার্ড আম্পায়ার।

পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না, ভারত পুরো টুর্নামেন্টে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এর সুযোগ পেয়ে প্রতিটি ম্যাচে ফ্রেশ হয়ে নামতে পেরেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ অন্য দলগুলো এক শহর থেকে আরেক শহরে গিয়ে টানা দুদিনে দুই ম্যাচও খেলেছে।

পরিসংখ্যানে এটা লেখা থাকবে না যে, ফাইনালের আগে বাংলাদেশ বিশ্রাম পেয়েছে মাত্র একদিন, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ভারতের জন্য বিশ্রাম দিবস রাখা হয়েছিল তিনদিন। পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না যে, এই বাংলাদেশ টিমে প্রধান দুই খেলোয়াড় তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান ছিলেন না। বলতে গেলে অর্ধশক্তির বাংলাদেশ টিম ২০১৮ সালের এশিয়া কাপকে উত্তেজনায় মাতিয়েছে।

অল্প ব্যবধানে বাংলাদেশ ফাইনালে হেরে গেলেও শুরুর দিকে দুটো ম্যাচ বাদে বাংলাদেশ যে ক্রিকেট খেলেছে সেটি দলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বাক্ষর বহন করছে। এশিয়া কাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে বিদেশের মাঠে সিরিজ জেতাও ভালো অর্জন ছিল। যদিও আফগানিস্তানের সাথে টি টুয়েন্টি সিরিজের সবগুলো ম্যাচে হারা ছিল খুবই লজ্জা ও হতাশার।

সে হতাশা কাটিয়ে উঠতে শিরোপা জেতার মিশন নিয়ে এশিয়া কাপ খেলতে আরব আমিরাত গিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। গ্রুপ পর্বে প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার সাথে অসাধারণ লড়াকু বিজয়। তামিম ইকবাল বলতে গেলে নিজের ক্যারিয়ার বাজি রেখে সেদিন ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়িয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন।

ভাঙা হাত নিয়ে এক হাতে কেউ ব্যাট করতে পারে সেটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম আগে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে প্রায় দেড়শ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন মুশফিক।

আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচে বাংলাদেশ আবার হেরে বসে। আফগানিস্তানের সাথেও হেরে শ্রীলঙ্কা টুর্নামেন্ট থেকেই বিদায় নেয়। সুপার ফোরে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ। শেষ ওভারে মোস্তাফিজুর রহমানের যাদুকরী বোলিং বহুদিন মনে থাকবে ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশিদের। পাকিস্তানের সাথে ম্যাচেও মাশরাফি বাহিনীর ঘাম ঝরানো বিজয়।

শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা ভারত ও বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলেছে। কিন্তু ভারতের ফাইনালে আসা আর বাংলাদেশের ফাইনালে আসার মধ্যে পার্থক্য আছে। ভারতকে আয়োজক সংস্থা থেকে অন্যায় সুবিধা দেয়া হয়েছে কৌশলে। ভারতকে পুরো টুর্নামেন্ট এ কোন বাড়তি জার্নি করতে হয়নি, সেখানে অন্য দলগুলো এক ম্যাচ খেলে ১.৫/২ ঘণ্টা বিমান জার্নি করে অন্য ভেন্যুতে গিয়ে কোন বিশ্রাম ছাড়াই পরবর্তী ম্যাচ খেলেছে।

এশিয়া কাপের সময়সূচি নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই। শেষ মুহূর্তে ভারতের জন্য সূচির পরিবর্তন করা হয়েছে। সবাই বলেছে, এশিয়া ক্রিকেট কাউন্সিল সবাইকে ‘সমান চোখে’ দেখছে না, ভারতকে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি সুবিধা।

প্রথম কথা ছিল, গ্রুপ ‘এ’ তে যে দল দ্বিতীয় হবে, তারা সুপার চারের প্রথম ম্যাচ খেলবে আবুধাবিতে। তবে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হয়, ভারত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলেও ম্যাচ খেলবে দুবাইতে। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে আবুধাবি ও দুবাইয়ে যাওয়া আসা করতে হবে।

ভারত হারলেও দুবাইতে ম্যাচ খেলবে! ভ্রমণ সবসময়ই শরীরকে ক্লান্ত করে। তার উপর যদি পরবর্তী ম্যাচের আগে বিশ্রাম না পাওয়া যায় তাহলে খেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে স্বাভাবিক। সব দলের জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত।

আইসিসিতে ভারতের অন্যায় আধিপত্যের ফলে মাশুল গুনতে হচ্ছে ক্রিকেটকে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড এর সিন্ডেকেশন এর জন্য ক্রিকেট প্রকৃত অর্থে সার্বজনীন হতে পারছে না। ক্রিকেট শুধু যেন কয়েকটি দেশের নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠছে। এখনো এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা অঞ্চলের অধিকাংশ রাষ্ট্র ক্রিকেট খেলে না। বিশেষ করে উপমহাদেশের ক্রিকেট দীর্ঘদিন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্দী ছিল।

শ্রীলংকা উঠে আসায় ভারত-পাকিস্তানের একক আধিপত্যে ভাটা পড়লেও ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচকে ঘিরে নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছিল। এখানেই ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। বদলে দিচ্ছে নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।

আয়োজকরা চাচ্ছিলেন ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হোক। ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হলে যে ব্যবসা ভালো হয় আয়োজকদের। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে শুধু ক্রিকেট খেলায় হয় না, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। পাকিস্তান মানে মুসলমানদের দল আর ভারত মানে হিন্দুদের দল, এমন একটা আবহ তৈরি হয় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচকে ঘিরে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়।

এদেশের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামান্য হলেও দূরত্ব সৃষ্টি হয় এই ম্যাচ হলে। নিজেদের কাজ ফেলে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এদেশের মানুষ। দেশাত্মবোধ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এখানেই দারুণ কাজ করছে বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সাম্প্রদায়িকতা থেকে উৎসারিত ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটকে তাই পুঁজিপতিরা তাদের ব্যবসার কাজেও লাগাতে চায়। এখানেই ‘কাবাব মে হাড্ডি’ হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। শুধু ক্রিকেট খেলে কোটি কোটি মানুষের মন জয় করে চলেছে বাংলাদেশ।

সবচেয়ে বিত্তশালী ক্রিকেট বোর্ড রয়েছে ভারতের। আইসিসিকেও তারা সবচেয়ে বেশি অর্থ দেয়। ভারতে ক্রিকেটকে ঘিরে যে বিশাল অর্থনীতি দাঁড়িয়েছে তাকে টিকিয়ে রাখতেই গোপনে খেলা না হয় না গেম।

বাংলাদেশের ক্রিকেট একদিকে ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ক্রিকেটকে চ্যালেঞ্জ করছে, অন্যদিকে মাঠের বাইরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা খেলাকেও চোখ রাঙাচ্ছে। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্রিকেটারগণ তো এমনই অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, হৃদয়বান ও সাহসী হবেন। তবে ক্রিকেটাররা যে পরিমাণ সাহসী আর দেশপ্রেমিক, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা কি তেমনই? এমন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।

নিজেদের খেলোয়াড়দের সাথে যখন এসিসি বৈষম্য করছে, তখন বিসিবির উচিত ছিল প্রতিবাদ করা। মাঠে যখন ম্যাচের পর ম্যাচ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের শুধু মিউজিক বাজানো হচ্ছিল তখন বিসিবির খোঁজ নেয়া উচিত ছিল সমস্যা কোথায়?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :