আবার খালের শহর হবে ঢাকা!

জহির রায়হান
 | প্রকাশিত : ০২ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:৫২

রাজধানী ঢাকার ধোলাইখাল ভরাট করা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সড়ক। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার কথা তখন মাথায় রাখা হয়নি। কিন্তু তারও অনেক পরে সেগুনবাগিচা খাল বন্ধ করার সময় সেই কথা ভাবা হয়েছে। তাই খালের উপরে সড়ক আর ভেতরে করা হয়েছে বক্স কালভার্ট। এই ব্যবস্থায় জলাবদ্ধতা সংকট থেকে মুক্ত রাখতে পারেনি এলাকাবাসীকে। এই সমস্যা সম্পর্কে জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই সম্প্রতি একাধিক বক্তব্যে জানিয়েছেন বক্স কালভার্ট ভেঙে খাল ফিরিয়ে আনা হবে। এ বিষয়ে নিশ্চয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তবে অন্তত পাঁচটি মরা খালের গতি বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমনকি জমি কিনে ঢাকায় নতুন খাল খনন করতে যাচ্ছে সরকার। হাজারীবাগ খালের উজানে ও ভাটিতে কুর্মিটোলা নামে এই নতুন খাল খননের জন্য এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

সরকারের এই উদ্যোগ সঠিক বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, খাল পুনরুদ্ধার ও নতুন খাল খননসহ রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ, সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে খাল পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে যেন দখলকারীদের টাকা দেওয়া না হয়। তাদের টাকা দিয়ে যেন কম্প্রোমাইজ করা না হয়। কারণ তারা তো সরকারি জায়গা দখল করে রেখেছিল এতদিন।

খাল পুনরুদ্ধারের পর সেগুলো যেন আবার ভরাট না হয়ে যায়, পানি যাতে দূষিত না হয় সেদিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ভাষ্যমতে, খাল সংরক্ষণে প্রয়োজনে এলাকাবাসীর সহায়তায় নিতে হবে। তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যেন খালের পানিতে কেউ প্লাস্টিক ও ময়লা না ফেলে। দখল ঠেকাতে খালের পারে সীমানা পিলার দিতে হবে। পরিবেশ ও নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, খাল খনন করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এটা ভালো। কিছু ময়লা তো পরিষ্কার হবে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ঢাকার চার পাশের নদী, জলাশয় ও খালের সমন্বয়ে ব্লু ওয়াটার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় উদ্যোগে পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের সড়কের দুই পাশে ১০০ ফুট চওড়া খালের খনন শুরু হয়েছে। এখানে আগে খালই ছিল না, জলাশয় ছিল। আর জলাশয় ভরাট করলে অবশ্যই সেখানে খাল রাখা উচিত।

ইকবাল হাবিব বলেন, আগে বৃষ্টির পানি ৫০ শতাংশ মাটির নিচে চলে যেত আর ৫০ শতাংশ খাল, নালাসহ বিভিন্ন জায়গায় জমা হতো। কিন্তু এখন পাকা হয়ে যাওয়ার জন্য এখন ৮০ শতংশ বৃষ্টির পানি জমে থাকে। দেখা যায় সেগুলোতে সৃষ্টি হয জলজট। তাই এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে খাল খনন করতে হবে।

ঢাকায় নতুন খাল

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে পুরনো খালগুলো দখলমুক্ত করতে না পারলেও পাঁচটি খাল খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য মালিকানা জমিও অধিগ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর খাল খননে ভেঙে ফেলা হবে বহুতল স্থাপনাও। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৭ কোটি টাকার কিছু বেশি, যা বাস্তবায়িত হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। তাই চলতি বছরেই এই প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে সরকার।

এসব খাল খননে অবকাঠামোর (ঘরবাড়ি/ভবন ইত্যাদি) জন্যও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেটি বুঝাতে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন প্রকল্প এলাকায় কারও ১০তলা ভবন পড়লে তাও ভেঙে ফেলার।’

২০১৭ সালে বছরজুড়ে ব্যাপক বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতার সমস্যা তীব্র হয়। পানি নিষ্কাশন ক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি বৃষ্টির পানি সরতে না পাড়ায় সড়ক এবং লোকালয়ে পানি জমে পরিস্থিতি শোচনীয় আকার ধারণ করে। এতে সরকারকে ব্যাপক চাপে পড়তে হয়।

আর ওই বছরই চলতি ২০১৮ সালে এই ধরনের পরিস্থিতি হবে না বলে অঙ্গীকার করা হয়। আর এ সময়ের মধ্যে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় একটি বড় খাল খননের কাজ করছে সেনাবাহিনী। এর বাইরে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

যে পাঁচ খাল খনন হবে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনভুক্ত মান্ডা, সবুজবাগ, বাসাবো ও হাজারীবাগ এবং উত্তর সিটির মিরপুর, পল্লবী, বাড্ডা ও রামপুরা থানা এলাকায় খনন করা হবে খালগুলো। ‘হাজারীবাগ, বাইশটেকি, কুর্মিটোলা, মান্ডা ও বেগুনবাড়ি খালে ভূমি অধিগ্রহণ এবং খনন-পুনঃখনন’ নামে নেওয়া প্রকল্পটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় ঢাকা ওয়াসা এটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাসে। শেষ হওয়ার কথা ডিসেম্বরে। এসব খাল খননে সরকারি জমির বাইরে ৩০ দশমিক ৫৬২ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে হাজারীবাগ খাল খননে ৪ দশমিক ৩৫৫ একর, বাইশটেকি এবং সাংবাদিক কলোনি খাল খননে ৬ দশমিক ৩৮৫ একর, কুর্মিটোলা খাল খননে ৪ দশমিক ৬১৩ একর, বেগুনবাড়ি খাল খননে ১ দশমিক ৯০৫ একর এবং মান্ডা খাল খননে ১৩ দশমিক ৩০৪ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।

পাঁচ খাল খনন প্রকল্পের পটভূমিতে বলা হয়েছে, প্রায় ১৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৪৪টি খাল, ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও বিভিন্ন সংস্থার কয়েক হাজার কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন হয় মহানগরে। ‘কিছু খাল বর্তমানে নগরবাসীর ব্যক্তিগত জমির মাধ্যমেও প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে ঢাকা ওয়াসার আইনগত কোনো কর্তৃত্ব নেই। এতে করে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকরা যেকোনো সময় তাদের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছামাফিক ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে নগরীর সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’

কুর্মিটোলা এলাকা, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও তৎসংলগ্ন এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য বিমানবাহিনী ঢাকা ওয়াসাকে অনুরোধ জানায় বলেও প্রকল্পের পটভূমিতে বলা হয়। এতে বলা হয়, হাজারীবাগ খাল, বাইশটেকি খাল, মান্ডা খাল এবং বেগুনবাড়ি খালগুলোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করে সংস্কার করা জরুরি প্রয়োজন। বর্জ্য পানি এবং বৃষ্টির পানি যাতে এসব খাল দিয়ে সহজে নেমে যেতে পারে সে জন্য বাইশটেকি খালের ভাটিতে সাংবাদিক কলোনি খালের পরে একটি খাল এবং মান্ডা ও বেগুনবাড়ি খাল চওড়া করা প্রয়োজন। এছাড়া হাজারীবাগ খালের উজানে ও ভাটিতে কুর্মিটোলা নামে একটি নতুন খাল খননের জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করা প্রয়োজন।

গত বছর ২৯ জুলাই ‘ঢাকা পানি সম্মেলনে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, পুরনো খাল সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন নতুন খাল খনন করা হচ্ছে। শহরে জলাধারগুলো সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় নতুন খাল খনন করা হচ্ছে এবং পুরনো খাল সংস্কার ও জলাধার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিল্পাঞ্চল, বড় বড় আবাসিক এলাকায় জলাধার তৈরি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, দূষিত পানি নিষ্কাশনেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

পূর্বাচলে খালের খবর

রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের দুই পাশে ১০০ ফুট চওড়া খালের খনন শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দেড় বছরের মধ্যে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সমস্যার অবসানের আশা করছে সংস্থাটি। তারা বলেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাজউক এবং ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড চলতি বছরেই কাজ শেষ করবে।

রাজউকের তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে খ্যাত নিকুঞ্জ, বাড়িধারা, জোয়ারসাহারা, ডিওএইচএস, ঢাকা সেনানিবাস, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কালাচাঁদপুরসহ সংলগ্ন কুড়িল ও পূর্বাচল এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ঢাকা মহানগরীর এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষাকালে জনগণকে প্রচ- দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাই ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়।

তখন প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার ২৮৬.৯১ কোটি টাকা। এরমধ্যে চার হাজার ৩৮৪.১৮ কোটি টাকা ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে ১৩.৬৪৩ কিলোমিটার খাল, ১৩ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, ৩৯ কিলোমিটার ওয়ার্কওয়ে, চারটি ইউলুপ, খালের ওপর ১৩টি আর্চওয়ে ব্রিজ তৈরি করা হবে। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়ে ফুটওভারব্রিজ চারটি, ২৬ হাজার লেনিয়া মিটার, এস এস পাইপসহ ফেন্সিং, একটি পাম্প হাউস, দুই হাজার ২৭০টি স্ট্রিটলাইট, ১২টি ওয়াটার বাস স্টপ নির্মাণ করা হবে।

ঢাকাটাইমস/২অক্টোবর/জেআর/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজধানী এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :