স্বাধীন সাংবাদিকতা বনাম আমলাতন্ত্র

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
 | প্রকাশিত : ০৩ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৪৫

একটি শঙ্কা সম্প্রতি আমাদের সমাজে তৈরি হয়েছে। কারণ, খুব তাড়াহুড়া করে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাস করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এক মাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটিবিষয়ক জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পাঠালেও কমিটি একদিনের মধ্যে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং গায়ের জোরে অপছন্দের মতকে চাপা দেওয়ার কিংবা তার পোষণকারীদের দমন করার প্রবণতা যেন শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে জোর করে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে, সামনের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে।

চূড়ান্ত ওই রিপোর্টে সাংবাদিক ও মিডিয়াবিষয়ক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ ও উদ্বেগের বিষয়টি একদম আমলেই নেওয়া হয়নি। অথচ আইনমন্ত্রী সম্পাদক পরিষদ, টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এটকো এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠক করে মতামত নিয়েছেন। সংসদীয় কমিটিও বসেছিল এবং কথা ছিল আরও একটি বৈঠক হবে। চূড়ান্ত ওই রিপোর্টে খসড়া আইনের (ড্রাফট অ্যাক্ট) ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এই অনুচ্ছেদগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে বলেই সাংবাদিক সমাজ মনে করছে।

একদিকে বর্তমান সরকার নিজেই তথ্য অধিকার আইন পাস করেছে, প্রস্তাবিত আইনের অধীনে তথ্য অধিকার আইনকে অন্তর্ভুক্ত করছে, আবার সেই ব্রিটিশ যুগের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টকে যুক্ত করেছে। এটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সুস্পষ্ট সাংঘর্ষিক। তার অর্থ হলো, ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ভঙ্গ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার সাজা হবে। এর সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড। এর মাধ্যমে আমলাতন্ত্র মূলত আবার সেই পুরনো সংস্কৃতিতে ফেরত যাওয়ার পথ তৈরি করছে, যেন নিজেদের সব দুর্নীতি চাপা থেকে যায়।

দুঃখজনক হলো, এমন একটি ব্যবস্থা আমলারা ফেরত আনতে যাচ্ছে কোনো অসাংবিধানিক সরকারের আমলে নয়, আওয়ামী লীগের মতো একটি গণভিত্তিক রাজনৈতিক দলের শাসনামলে।

সম্পাদক পরিষদ ও মনজুরুল আহসান বুলবুলের নেতৃত্বাধীন বিএফইউজের আগের কমিটি এই আইনের ৮টি (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩) ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, এসব ধারা বাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা হতে পারে। এছাড়া ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা এই আইনের ৪টি (২১, ২৮, ৩২ ও ২৫) ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৮) পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিল।

মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা এবং তার মতামত নেওয়ার প্রস্তাবও করেছিলেন। কিন্তু সংসদীয় কমিটি এই আইনে কোনো পরিবর্তনই আনেনি। আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাকে নতুন আইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে ৫৭ ধারা থাকছে না। এই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করে মূলত গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ জনগণের তথ্য অধিকারকে হরণ করে নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই আইনে যেভাবে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে সাংবাদিকতা করা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে ভাবা দরকার।

তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সরকারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরির ব্যাপারে সম্পাদক পরিষদ ছাড়া সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো এখন পর্যন্ত নীরব হয়ে রয়েছে।

সাংবাদিকরা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা একটি ডিজিটাল আইন চান। কিন্তু আইনটি পাস হলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হুমকিতে পড়বে, সাংবাদিকদের এমন উদ্বেগকে কোনো আমলেই নিতে চাচ্ছে না সরকার।

সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, কমছে সাংবাদিকের স্বাধীনতা। স্বাধীন সাংবাদিকতার সূচকে আমরা কেবল পিছিয়েই যাচ্ছি। রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষ করে আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে শাসক শ্রেণি যেভাবে সংবাদমাধ্যমের প্রতি বিষোদ্গার করাকে সংস্কৃতি মনে করে, তারা তাদের জন্য এই নতুন আইনকে বিশেষ উপহার হিসেবে দেখবে।

সত্যের অনুসন্ধান, তথ্যের প্রকাশ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। গুজব বাড়ছে এবং স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আঘাত করলে যে গুজবকেই প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়া হবে, তা শাসকদের বোঝাবে কে? সত্যি বলতে কী, এই আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশ সংকুচিত হলে ক্ষতি শুধু সাংবাদিকের হবে না, হবে পুরো জাতির। বিতর্কহীন আদর্শ-আনুগত্যকে যত প্রশ্রয় দেওয়া হবে, চিন্তার স্বাতন্ত্র্য এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ততই বিপন্ন হবে। আমি মনে করি, একটি শ্রেণি সরকারের ভেতরে থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এমন সব আইনের প্রলোভন দেখিয়ে গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাত তৈরির প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

তথ্যের প্রবাহে বাধা সৃষ্টির অন্তর্নিহিত সত্য হলো জবাবদিহির দায়মুক্তি। শাসক স্বৈরতন্ত্রী হতে চায়, জনসাধারণের মৌলিক অধিকার হরণ করতে চায়, গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনপ্রণালির সুফল হতে দেশবাসীকে দূরে রাখতে চায় এগুলো পুরনো ধ্যান-ধারণা। কিন্তু শাসকের ভেতরে থাকা আমলাতন্ত্র শাসন ব্যবস্থাকে পুরনো পথেই নিতে চায়। রাজনীতির সঙ্গে আমলাদের কায়েমি স্বার্থ যদি মিলিয়ে ফেলা যায়, তাহলে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠবেই।

এই জামানায় কত সহজেই না নিজের কথা বলা যায়, আবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এই জামানায় কত সহজেই না খর্ব করা যায়। এই খর্ব করার কাজটিকে কি কার্যত স্বাভাবিক করার চেষ্টা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মোড়কে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :