শেখ হাসিনা

সময়ের প্রয়োজনে বিকল্পহীন তিনি

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)
 | প্রকাশিত : ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ১২:১৪

বঙ্গবন্ধুর এক ঘনিষ্ঠজন তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন শেখ মুজিবের পর কে আসবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এ কথার উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি জানি না। তবে এমন একজন আসবে যার কথা আমি এখনো ভাবতে পারছি না, আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না। তারপর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনা কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এলেন সে কথা আমরা সবাই জানি।

শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের জন্য এ দুটি পরিচয় অত্যন্ত বড় গৌরব ও সম্মানের। কিন্তু শেখ হাসিনার জন্য এর চেয়ে অনেক বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, বড় মেয়ে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে ২০১৮ সালের শেষ প্রান্ত, প্রায় ৩৭ বছর। এই ৩৭ বছর আমরা কী দেখলাম। একটা বুলেট সব সময় শেখ হাসিনার পেছনে ধাওয়া করছে। ১৯ বার তাকে হত্যা করার চেষ্টা প্রকাশ্যে দেখা গেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণের কথা এখন সবাই জানেন। বাংলাদেশে তো অনেক নেত্রী আছেন, অনেকেই প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাদের হত্যা করার প্রচেষ্টার কথা তো শোনা যায় না, কারও গায়ে তো একটা টোকাও এ পর্যন্ত লাগেনি। সুতরাং সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে কিসের জন্য এবং কারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়। এ প্রশ্নটির উত্তর এখন বাংলাদেশের মানুষের জানা।

পঁচাত্তরে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তারাই ওই একই কারণে শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিশ্লেষণ এবং শেখ হাসিনাকে ১৯বার হত্যা প্রচেষ্টার নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহ পর্যালোচনায় দেখা যাবে এর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাংলাদেশের পরিবর্তে পাকিস্তানের মতো ধর্মান্ধ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রাষ্ট্র তৈরি করা এবং সেটিকে বিশ্বের পরাশক্তির একটি ক্লায়েন্ট বা আজ্ঞাবাহী রাষ্ট্র বানিয়ে রাখা।

বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা পিতার মতো দেশের স্বার্থে আপসহীন ভূমিকা নিয়েছেন বলেই পঁচাত্তরের ঘাতকদের উত্তরসূরি বা সেই একই অপশক্তি কর্তৃক বারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে এবং এখনো সে চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ সেথা শির পিতার কাছ থেকে পাওয়া এই মহান শিক্ষাকে অবলম্বন করে শেখ হাসিনা এগিয়ে চলেছেন বলেই আজ আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। ২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে যখন প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বলেন ৫০ বছরের রিজার্ভ নিশ্চিত না করে বাংলাদেশের গ্যাস রপ্তানি করা হবে না, তখন শেখ হাসিনার ভেতর মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। এ কারণেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১০ বছরে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। এ সময়ে বড় বড় সব জাতীয় এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন বলেই তরুণ প্রজন্মের সামনে বিশাল অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আমেরিকার ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরআইয়ের (ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট) সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ মনে করে আগামী ১৫ বছরে দেশের আরও উন্নতি হবে, যদি বর্তমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান একইভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী প্রতিবেদন দিচ্ছে।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আইআরআইয়ের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের শতকরা ৬৬ ভাগ মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। শতকরা ৬৪ ভাগ সরকারের ওপর আস্থাশীল এবং শতকরা ৬২ ভাগ মানুষ মনে করে দেশ সঠিক পথে আছে। এর আগে ২০১৫ সালে আইআরআইয়ের আরেকটি প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে দেশের শতকরা ৫৪ ভাগ মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগে বর্তমানে স্ট্রং বা শক্তিশালী নেতৃত্ব রয়েছে, আর এ বিষয়ে বিএনপির নেতৃত্বের কথা বলেছে মাত্র শতকরা ২২ ভাগ মানুষ। শক্তিশালী নেতৃত্বের গুণে দেশের মানুষ স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথার্থ অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছেন বলেই ১৬ কোটি মানুষের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছে। বেশি দিনের আগের কথা নয়, ২০০১-০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলতেন, উত্তরবঙ্গে মঙ্গা হয়েছে তো তাদের ভাতের পরিবর্তে পাতাকপি খেতে বলো। তিনি আরও বলতেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবে না। সেই জায়গা থেকে মাত্র এই কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ আজ মঙ্গা শব্দটি ভুলে গেছে।

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের লিখিত বই ইগনাইটেড মাইন্ড। কয়েক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। এই বইয়ের ১৩৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, একটা রাষ্ট্রের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত নাকি বন্ধ তা বোঝা যায় পাঁচটি প্রধান সেক্টরের অবস্থা দেখে। সেক্টরগুলো কৃষি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্ট্র্যাটেজিক সেক্টর। আবদুল কালাম লিখেছেন, এই পাঁচটি সেক্টরের ক্রান্তিকাল অতিক্রমের গ্রাফ দেখেই বোঝা যায় দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে কি না। শেখ হাসিনার চরম শত্রুকেও আজ স্বীকার করতে হবে চলমান দুই মেয়াদের প্রথম মেয়াদেই বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলভাবে কৃষি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে। চলমান মেয়াদে পারমাণবিক যুগে প্রবেশ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক সাব-মেরিন সংযোজনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্ট্র্যাটেজিক সেক্টরের ক্রান্তিকালও অতিক্রম করেছে। এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়া। তবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দণ্ডায়মান। তাই রাস্তা মসৃণ নয় এ কথাটি মনে রাখতে হবে।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এবং শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাত্র দেড় বছরের মাথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ২১ বছরের ঘনীভূত সশস্ত্র বিদ্রোহের যেভাবে শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাধান করেছেন তার উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। কোনো তৃতীয় পক্ষ বা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে তিনি অসাধ্যকে সাধন করেছেন।

৪০ হাজার উপজাতি শরণার্থীকে বিদেশ থেকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনেছেন। ভয়ংকর ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। শেখ হাসিনা যদি দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের পরাশক্তির সঙ্গে কিছুটা হলেও আপস করতেন তাহলে এই পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য তিনি অনেক আগেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারতেন। মিয়ানমার-ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি, ছিটমহল বিনিময়, ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সীমান্তের মীমাংসা, এর প্রতিটি ঘটনায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাহস, গভীর দূরদৃষ্টি এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণের প্রতিফলন পাওয়া যায়।

শুধু অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নয়, ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতেও তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আমেরিকা সুপার পাওয়ার, ভারত উদীয়মান বড় শক্তি ও প্রতিবেশী, চীন প্রতিবেশী এবং প্রচণ্ড গতিতে উদীয়মান সুপার পাওয়ার। এই তিন শক্তির মধ্যে আবার প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা রয়েছে। কিন্তু এই ত্রি-শক্তির সবার সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তিন শক্তিকেই একই সঙ্গে উন্নয়নের অংশীদার করেছে তা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটা আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। ঢাকায় এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আগের মতো ভাইসরয় সুলভ দাপট আর নেই। বাংলা মাকে কালিমা মুক্ত করার জন্য নিজের শারীরিক ও রাজনৈতিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করেছেন তা যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য শুধু বিস্ময়ের ব্যাপারই নয়, বিশ্বাস করাই কঠিন।

রোহিঙ্গা সমস্যাতেও শেখ হাসিনার সরকার যে সংযম, ধৈর্য, মানবতাবোধের পরিচয় দিয়েছে তা সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে শেখ হাসিনা মাদার অব হিউম্যানিটি বা মানবতার জননী উপাধি পেয়েছেন। তাই বলতে চাই তিনি আজ বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তা কেবল সম্ভব হয়েছে তিনি শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর মেয়ে বলে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই বিকল্পহীন তিনি।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :