মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে ইউএনও ইসরাতের নানা উদ্যোগ

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:২৪

জাহাঙ্গীর হোসেন, মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদমীন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইউএনও হিসেবে যোগদানের পর থেকে এ উপজেলায় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

এছাড়া সরকারি সম্পত্তি রক্ষা, মাদক ব্যবসা ও জুয়া বন্ধ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা যৌতুকের বিরুদ্ধে নানামুখী সচেতনামূলক সভা-সমাবেশ করে সকল মহলে হয়েছেন প্রশংসিত। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিজস্ব চিন্তাধারায় বাস্তবায়ন করে স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন পরপর দুইবার জেলার সেরা ইউএনও খেতাব। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে নিরলসভাবে কাজ করায় আইসিটিতে পেয়েছেন জেলার সেরা ইউএনও পুরস্কার।

‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করি, মেধাসম্পন্ন জাতি গড়ার প্রাথমিক সোপান গড়ি’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে দিন-রাত নানা কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। ২৮তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা মনে করেন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা মেধাসম্পন্ন জাতি গড়ার মূল ভিত্তি। ছোট্ট সোনামণিদের মধ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার বীজটি বপন করে সঠিক পরিচর্যা করা গেলে তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে আগামী দিনের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় কর্মকর্তা তথা মেধাসম্পন্ন নাগরিক। সে জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকভাবে গড়ে তোলার মাধ্যমে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। 

ইউএনও ইসরাত সাদমীন বলেন, মির্জাপুরে ইউএনও হিসেবে যোগদানের পর প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী শারমিনের মুখে যখন শুনতে পেলাম ‘ম্যাডাম, আমি ইউএনও হইতে চাই’ তার সেই আত্মপ্রত্যয়ী কথা শুনে অবাকই হয়েছিলাম। সেই সঙ্গে মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিল মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে কি করা যায়। 

উপজেলার ১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে সেতুবন্ধন গড়ার কাজ শুরু করি। সরকারি কর্মসূচির আলোকে এবং নিজস্ব চিন্তাধারা নিয়ে একের পর এক বিদ্যালয় পরিদর্শন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতে চলতে থাকে আমার কর্মকাণ্ড। বিদ্যালয়গুলোতে মিড-ডে-মিল চালু এবং তা সচল রাখতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে টিফিন বক্স বিতরণ শুরু করি। এতে অল্প দিনে শিশুরা পাঠে অধিকতর মনযোগী হয়ে উঠে এবং ঝরে পড়ার সংখ্যা হ্রাস পায়। শিশুদের স্কুল রঙিন করণে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ আকর্ষণীয় করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করি। অভিভাবক ও শিক্ষক পরস্পরের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য নিয়মিত অভিজ্ঞতা বিনিময় সভার আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

শিক্ষকদের প্রতিটি মাসিক সভায় স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষায় উৎসাহ প্রদান, শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা যথাযথভাবে বিকশিত হয়েছে কিনা তা নিয়মিত যাচাইপূর্বক ‘বুদ্ধিমত্তা উৎসাহ স্মারক’ প্রদান, তাদের সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের প্রাধান্য দিয়েছি।

তিনি বলেন, শিশুদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটাতে আয়োজন করেছি যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা। এছাড়া শিশু শিক্ষার্থীদের মনকে নির্মল ও সতেজ রাখতে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ফুল বাগান তৈরিতে উৎসাহ প্রদান করেছি। শ্রেণি কক্ষে মনোমুগ্ধকর আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য পাঠ দানে আকর্ষনীয় উপকরণ ব্যবহারপূর্বক শাস্তি পরিহার করে শিশুদের স্নেহ-ভালবাসার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করাসহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর প্রতি গুরুত্বদানে শিক্ষকদের নিয়মিত উৎসাহ প্রদান করেছি।

মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষার বিষয়ে সকলকে ব্যাপকভাবে অবহিত করেছি। স্থানীয় জনগণ, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তর হতেই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ভিত্তি তৈরিতে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার এবং মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রাপ্ত বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে নিয়মিত মনিটরিং করে ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে।

এই সফল ইউএনও বলেন, শিশুদের ভাল ফলাফলের স্বীকৃতিস্বরূপ অভিনন্দনপত্র প্রদান করেছি।

শিশুদের মধ্যে উৎসাহ জাগাতে ও নেতৃত্ব বিকাশে তিনি তার নিজ কার্যালয়ে ‘প্রাথমিকা’ নামক ফটোগ্যালারিতে মাসভিত্তিক শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচিত করে ওই শিক্ষার্থীর ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

শিশুদের মানসিক বিকাশ সাধনে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্রীড়াসামগ্রী বিতরণসহ খেলাধুলার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘আখর’ নামক বর্ণমালা পার্ক স্থাপনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। শিশুদের মাঝে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে বিদ্যালয়ে মিনি লাইব্রেরি স্থাপন করতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

বৈরি আবহাওয়াতেও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের  শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ‘রোদ বৃষ্টিতে ভয় নাই; সময়মত স্কুলে যাই’ শীর্ষক স্লোগানে শিক্ষার্থীদের মাঝে ১০০০ ছাতা বিতরণ করা হয়েছে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

বিদ্যালয়সমূহে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পরিচালনার বিষয়ে নিয়মিত তদারকি অব্যাহতের পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে স্কুল ড্রেস, খাতা, কলম, স্কুল ব্যাগ ইত্যাদি বিতরণ করা হয় মির্জাপুর উপজেলায়।

‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিদ্যাঙ্গনে; পড়াশোনা করি সুস্থ দেহ মনে’ শীর্ষক স্লোগানে বিদ্যালয় অঙ্গনকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে একযোগে উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

‘লাগাই তালবৃক্ষ প্রেয়সী মির্জাপুরে; বজ্রপাতে মরণ ভীতি হারিয়ে যাক চিরতরে’ এই স্লোগানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে চার লাখ তাল গাছ ও তালবীজ রোপন ও বপন করার আয়োজন করেন এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

‘সবুজে ঘেরা বিদ্যাঙ্গনে; নিঃশ্বাস নিই বিশুদ্ধ অক্সিজেনে’ এই স্লোগানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একযোগে বৃক্ষরোপন করা হয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘অভিযোগ বক্স’ স্থাপনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। একযোগে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেয়াল পত্রিকা উন্মোচন করা হয়।

শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতাবোধ জাগাতে ‘সততা স্টোর’  এবং ‘দর্পণ স্টোর’ চালু করতে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়েছে উপজেলা প্রশাসন থেকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাব স্কাউটিং কার্যক্রম গতিশীল করতে নিয়মিত মনিটরিংসহ বাঁশি সরবরাহ এবং শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের বিশেষ সংবর্ধনা দিয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে।

‘আত্মরক্ষার্থে  শিখি কুংফু কারাতে’ শীর্ষক স্লোগানে শিশু ও কিশোরী-মেয়েদেরকে কুংফু কারাতে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশু ও কিশোরী মেয়েদের মানসিক শক্তিতে বলীয়ান করতে আয়োজন করা হয় ফুটবল টুর্নামেন্টের।

একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘কন্যা সাহসিকা’ টিম গঠন করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাইকেল বিতরণ করেন ইউএনও ইসরাত সাদমীন।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ভাল ও মানসম্মত ফলাফল নিশ্চিত করতে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের ডাটাবেজ প্রস্তুতপূর্বক তাদের সাথে মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ সহজীকরণে করা হয়েছে ‘প্রাথমিকা’ নামক পুস্তিকা। ‘প্রাথমিকা’ নামে ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ খোলা হয়েছে।

বিদ্যালয় চলাকালে অভিভাবকরা যাতে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি থাকার মাধ্যমে তাদের মানসিক শক্তি যোগাতে পারেন, সেজন্য ‘অভিভাবক কর্নার’ তৈরিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্বুদ্ধ করেন এই ইউএনও।

ইউএনও ইসরাত সাদমীন মনে করে, সরকারের মাঠ প্রশাসনের এই পদটি যেহেতু বদলি জনিত। সে কারণে তাকেও হয়তো অন্যত্র চলে যেতে হবে। তবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে তিনি যে সকল কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছেন এবং যে সকল কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে- এসব এগিয়ে নিলে সত্যিকার অর্থেই আগামী প্রজন্ম মেধাবী হবে।

(ঢাকাটাইমস/১২অক্টোবর/প্রতিনিধি/এলএ)