লাউড় দূর্গ খুঁড়ে তুলে আনা হবে সুপ্রাচীন ইতিহাস
সুপ্রাচীন লাউড় রাজ্য যুক্ত করেছে আদি বাংলার ইতিহাসের কয়েকটি যুগকে। মোগল আমলে লাউড় নামে স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠলেও হাজার বছর ধরে মহাভারত, রামায়ণ, পাল, সেন, হযরত শাহজালাল (রা.), সুলতানি আমল এবং শ্রী চৈতন্যের প্রভাবও ছিল সুবিস্তৃত এই জনপদে, যার কেন্দ্রস্থল বর্তমানে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে।
উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়া গ্রামে লাউড় রাজ্যের রাজধানীর অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের সেসব উপাখ্যান। সেগুলোর মাঝে লাউর দূর্গের ধ্বংসাবশেষ সবচেয়ে বড় সাক্ষী কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া লাউড় রাজ্যের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার।
‘লাউড়ের হাউলী বা হাবেলী’ নামে পরিচিত এ দূর্গে খনন করা গেলে তাই তুলে আনা যাবে সুপ্রাচীন ইতিহাসের সেসব অধ্যায়গুলো। এ বিশ্বাস থেকে লাউড় দূর্গ খোঁড়ার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হলহলিয়া গ্রামে ৪ জন গবেষক
গত মঙ্গল ও বুধবার এই দূর্গ খননের আগের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে গেছেন।লাউড়েরগড়ের ঐতিহাসিক এই স্থানে দুইদিন সরেজমিনে ঘুরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্রগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গবেষকরা বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক আরও অনেক নিদর্শন পাওয়া যাবে।’
ইতিহাস বলে, দ্বাদশ শতকে কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র বংশের কেশব মিশ্র প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন লাউড় রাজ্য ছিল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকায় লাউড়ের রাজধানী ছিল। এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ হলহলিয়া গ্রামে এখনো বিদ্যমান।
তবে রাউড়ের ইতিহাসের সূচনা আরও হাজার হাজার বছর আগে। মহাভারত ও রামায়ণের নানা চরিত্র ছাড়াও পাল ও সেন রাজারা, হযরত শাহজালাল (রা.) এবং সুলতানি আমল ও মোগল আমলের নৃপতিরা এমনকি শ্রী চৈতন্যও এই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এখানকার রাজা ভগদত্ত মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনকে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী মহাকবি সঞ্জয়’র নিবাসও ছিল এই এলাকায়। হযরত শাহজালালের (র.) সঙ্গী শাহ আরেফিন (র.) এবং মহাপ্রভু শ্রীশ্রী চৈতন্যদেবের সহচর অদ্বৈতাচার্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিল লাউড় রাজ্য।
সুদীর্ঘ ২০০ বছর এই ঐতিহ্যের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে পর্যবেক্ষক দলের নেতা ড. আতাউর রহমান জানান, খনন কাজ শুরুর আগে যাচাইয়ের অংশ হিসাবে এই জরিপ কার্যক্রম করলেন তারা।
ড. আতাউর রহমানের মতে, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল যেমন বরেন্দ্র অঞ্চল, গৌড় অঞ্চল, দক্ষিণবঙ্গের ষাট গম্ভুজ বা বারোবাজারে যেভাবে গবেষণা হয়েছে, সেই তুলনায় সিলেট অঞ্চলে গবেষণা হয়নি। এখন কিছু কাজ শুরু হয়েছে এবং লাউড়েরগড়ে বিস্ময়কর কিছু তথ্যভাণ্ডারের খোঁজ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী বলছেন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এ খননের মাধ্যমে ইতিহাসের নতুন দিগন্ত আবিস্কার করতে পারবে। না হলে এই এলাকা ভূমিদস্যুদের দখলে গেলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।
ইতিহাস বলছে, প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীহট্ট (সিলেট) কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ত্রৈপুর রাজবংশ অধ্যূষিত স্থান ত্রিপুরা রাজ্য বলে সাধারণত কথিত হয়। এই রাজবংশের অধিকার একসময় বরবক্রের সমস্ত বামতীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্রীহট্টের তিনভাগ শাসন করতেন তিনজন পৃথক নৃপতি। গৌড়, লাউড় ও জয়ন্তিয়া- এই তিনখণ্ডে নৃপতিদের অধীনস্ত ছিলেন আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিমালিক।
এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশব মিশ্র। তারা ছিলেন কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র। তাদের উপাধি ছিল সিংহ। খ্রিস্ট্রীয় দশম অথবা একাদশ শতকে মিশ্ররা কনৌজ থেকে এখানে আসেন। দ্বাদশ শতকে এখানে নৃপতি বিজয় মাণিক্য রাজত্ব করতেন। বঙ্গ বিজয়ের পর রাঢ় অঞ্চল মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়ায় সেখানকার বিতাড়িত ও পরাজিত সম্ভ্রান্তজনেরা প্রাণ ও মান বাঁচাতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়িয়েছিলেন।
তাদেরই একজন এখানে এসে রাজত্ব গড়ে তোলেন। রাঢ় শব্দ থেকেই লাউড় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। লাউড় রাজ্যের রাজধানী লাউড় ছাড়াও জগন্নাথপুর ও বানিয়াচংয়ে আরও দুইটি উপ রাজধানী ছিল।
ঐতিহাসিক হান্টারের মতে, সম্ভবত ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলরা এর নিয়ন্ত্রক হন। লেখক সৈয়দ মূর্তজা আলী ‘হযরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন,মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তার জ্ঞাতি ভ্রাতা জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সাথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এর জেরে বিজয় সিংহ গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন। বিজয় সিংহের বংশধররা এ হত্যার জন্য গোবিন্দ সিংহকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে বিচার প্রার্থনা করেন। এ ঘটনার বিচার করতে সম্রাট আকবর দিল্লি থেকে সৈন্য পাঠিয়ে গোবিন্দ সিংহকে দিল্লির রাজদরবারে ডেকে নেন। বিচারে গোবিন্দ সিংহের ফাঁসির হুকুম হয়।
গোবিন্দ সিংহের অন্য নাম ছিল জয় সিংহ। একই সময়ে জয় সিংহ নামের অন্য একজনও রাজা গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে সম্রাট আকবরের কারাগারে আটক ছিলেন। ভুলবশত প্রহরীরা গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে ওই জয় সিংহকে ফাঁসিতে ঝুলান। গোবিন্দ সিংহের প্রাণ এভাবে রক্ষা পাওয়ায় তিনি কৌশলে সম্রাট আকবরের কাছ থেকে নানা সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি সম্রাট আকবরের কাছে প্রাণভিক্ষা চান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। গোবিন্দ সিংহের নাম হয় হাবিব খাঁ। সম্রাট আকবর গোবিন্দ সিংহকে তার হৃতরাজ্য ফের দান করেন। অবশ্য শর্ত দেওয়া হয়, হাবিব খাঁ সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং খাজনার পরিবর্তে ৬৮টি কোষা নৌকা নির্মাণ করে সম্রাটকে সরবরাহ করবেন। ওই নৌকাগুলো খাসিয়াদের আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার্থে মোগল ও স্থানীয় বাহিনী রণতরী হিসাবে ব্যবহার করবেন।
প্রাচীন নানা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, হাবিব খাঁ’র পৌত্র ছিলেন মজলিস আলম খাঁ। মজলিস আলম খাঁ’র পুত্র ছিলেন আনোয়ার খাঁ। তিনি খাসিয়াদের উৎপাতে সপরিবারে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড় ছেড়ে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এই বংশেরই উমেদ রাজা লাউড়ে দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দূর্গের ধ্বংসাবশেষই লাউড়ের হাউলী বা হাবেলী নামে পরিচিত।
(ঢাকাটাইমস/১৩অক্টোবর/প্রতিনিধি/এআর)