পুলিশের গুলিতে মেয়ে হারানো বাবা-মায়ের অন্যরকম লড়াই

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১১:১০

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

আমল উমর নামের ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে গত আগস্টে করাচীর ব্যস্ত রাস্তায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারায়। ওই পুলিশ কর্মকর্তা গুলি ছুড়েছিলেন একজন অপরাধীকে লক্ষ্য করে।

এরপর আমলের বাবা-মা এক ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন যেখানে তারা এই প্রক্রিয়াকে একটি ভগ্ন এবং জবাবদিহিতা-হীন প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করে তা পাল্টানোর দাবি তুলে ধরেছেন। তারা এর ফলাফলও পেতে শুরু করেছেন।

বিনীশ উমর এবং তার স্বামী উমর আদিল দম্পতির জন্য পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায়, একটি অর্কেস্ট্রা কনসার্টে আনন্দময় পারিবারিক উদযাপনে যাওয়ার সময়টা হঠাৎ করে দু:স্বপ্নে পরিণত হয়। যখন তাদের গাড়িটি পুলিশ ও একদল ছিনতাইকারীর ক্রসফায়ারের মাঝখানে পড়ে যায়।

রাত তখন দশটা। ১৩ই আগস্ট। দক্ষিণ করাচীর একটি সড়কে একটি সিগনাল বাতির সামনে পরিবারটি এসে থামে। তারা দেখতে পায় একজন অস্ত্রধারী লোক গাড়ির চালকদের হুমকি দিচ্ছে এবং অস্ত্রের মুখে তাদের ফোন দিয়ে দেয়ার জন্য বলতে থাকে। লোকটি পরিবারটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

তারা জানালার কাছে গুটিয়ে বসে এবং শান্তভাবে বিনীশের পার্স এবং তার স্বামী উমরের মোবাইল ফোন ছিনতাইকারীর কাছে দিয়ে দিতে রাজী হয়। লোকটি ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। সে জিনিসগুলো নিয়ে নেয় এবং তাদের পেছনের দিকে আরেকটি গাড়ির দিকে চলে যায়।

তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম বিপদ বিদায় হয়েছে, কিন্তু সেটা প্রচুর গুলির শব্দ শোনার আগ পর্যন্ত এবং আমাদের গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে একটি গুলি এসে লা্গার আগ পর্যন্ত। আনিয়া ছিল পেছনের সিটে বসা, সে চিৎকার শুরু করলো’।

গুলিবিনিময় বন্ধ হলে আতঙ্কিত বিনীশ তার মেয়েদের কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা দেখতে শুরু করেন। আনিয়া আতঙ্কিত এবং কান্না করছে। কিন্তু আমল একেবারে শান্ত। বিনীশ গিয়ে তার মেয়েকে স্পর্শ করলেন এবং দেখলেন তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। এরপর তারা নিকটবর্তী হাসপাতালের ছোটেন। সে রাতটি হয়ে উঠেছিল তাদের জন্য নির্মম দু:খ আর হতাশার এক রাত।

উমর বলেন, ‘যে মুহূর্তে আমরা ন্যাশনাল মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছেছি, হাসপাতালের কর্মীরা এবং পুলিশ কর্মকর্তারা এমন আচরণ করতে লাগলেন যে ওই রাতে রাস্তায় বের হওয়াটাই ছিল আমাদের দোষ’।

বিনীশ বলেন, ‘হাসপাতালের লোকজন আমলকে ঘিরে রেখেছিল। এরপর তারা আমলকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। আমরা বললাম, ভাল কথা, আমরা তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবো। কিন্তু আপনারা কি দয়া করে অন্তত একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? এর উত্তরে তারা জানিয়েছিল আমাদেরই তা ডাকতে হবে'।

উমর বলেন, 'তারা আমাদের অ্যাম্বু ব্যাগ কিংবা তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সহায়তার জন্য টিউব দিতেও অস্বীকৃতি জানায়’।

হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডক্টর ওমর জং অবশ্য এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে ডন পত্রিকাকে বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসকরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন আমলকে বাঁচাতে, কিন্তু তাকে যখন নিয়ে ভেন্টিলেটর দেয়া হয় ততক্ষণে সে ক্লিনিক্যালি ডেড বা মৃত।

কিন্তু আমলের বাবা-মা জানান, তারা হাসপাতালে আসার পরও ১৫ মিনিট ধরে চ্যারিটি থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানের জন্য বলতে থাকেন কিন্তু ততক্ষণের তাদের প্রিয় সন্তান আর নেই।

পুলিশের পক্ষ থেকে করা প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ সদস্যদের দোষ আড়াল করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য নেয়া হয়েছে- সেখানে বলা হয়েছে- চোর পালিয়ে চলে গেছে এবং সেজন্য পুলিশ কর্মকর্তারা গুলি ছুড়েছেন। সে পুলিশের দিকে গুলি ছুড়েছে, আমল অপরাধীর অস্ত্র থেকে ছোড়া বুলেটের আঘাতে মারা গেছে ইত্যাদি। কিন্তু বিনীশ এবং উমর এর দাবি তাদের গাড়ির পেছন দিক থেকে গুলি এসে লেগেছে আমলের মাথায়, এবং তা কোনও পুলিশ সদস্যের ছোড়া গুলি থেকে।

এর কিছুদিন পর সিন্ধু প্রদেশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল জাভেদ ওধো স্বীকার করেন যে আমল একজন পুলিশ কর্মকর্তার অনিচ্ছাকৃতভাবে ছোড়া গুলিতে মারা গেছে। উমরের গাড়ির বুটে এক ইঞ্চি বুলেটের গর্ত দেখা গেছে। পুলিশ কর্মকর্তা মিস্টার ওধো জানান, দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং অপরাধী দলের একজন নিহত হয়েছে।

তারপর থেকে করাচীতে পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল কিংবা কালাশনিকভ ইস্যু করার বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছেন জাভেদ ওধো।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরো করাচিজুড়ে সড়কে সংঘাত সহিংসতা, চুরি ছিনতাই ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধান প্রধান সড়ক এবং ট্রাফিক সিগন্যালগুলো নির্দিষ্ট বিপদজনক এলাকা হয়ে উঠেছে।

শহরের নতুন নিযুক্ত পুলিশ প্রধান আমির আহমেদ শেখ পুলিশের এ ধরনের অস্ত্রের ঐতিহাসিক ব্যবহারকে সমর্থন করে বলেছেন, অপরাধীদের দীর্ঘদিন ধরে এমন অস্ত্র ব্যবহারের সহজ সুযোগ রয়েছে।

যে ঘটনাটি ঘটেছে তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এখনো লড়াই করছে পরিবারটি। তারা নীরব থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আওয়াজকে তুলে ধরতে চান।

এই দম্পতি তাদের কষ্টকে নীরবতায় হারিয়ে যেতে দিতে রাজী নন। তারা চান না আমলের মৃত্যুর ঘটনার কথা সকলে ভুলে যাক এবং তারা চান না যে, কর্তৃপক্ষ যেন মনে না করে যে, রাস্তায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের সংঘাতে 'কোলাটেরাল ড্যামেজ' হিসেবে এমনটা হতেই পারে।

করাচীতে নিজেদের বাসভবনে এক সাক্ষাতকারে বিনীশ বলেন, ‘আমাদের সন্তান আমাদের কাছে আর ফিরে আসবে না। আমরা এই বাস্তবতার সংজ্ঞা তুলে ধরতে এসেছি। এই বিষয়ে কথাবার্তা শুরুর মাধ্যমে যদি এই ধরনের ঘটনার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসে তাহলে সেটাই হবে সাফল্য’।

এই দম্পতির মতে, পুলিশ ও চিকিৎসকরা উভয়পক্ষই তার মেয়েকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা চ্যালেঞ্জ দিয়ে তারা বলছেন একে তারা মনে করছেন, পাকিস্তানী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা প্রদর্শনের সংস্কৃতি হিসেবে।

আমলের মা বিনীশ বলেন, 'আমরা এমন এক সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছি যেখানে অনেক সত্যকে প্রকাশ্যে আনলে কিংবা প্রকাশ্যে কাঁদলে দেটিকে দেখা হয় দুর্বলতা হিসেবে। কিন্তু তারপরও আমাদের সিস্টেমের মধ্যে কিংবা এই প্রক্রিয়ায় কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে যদি পরিবর্তন আনতে পারে, হাসপাতাল কর্মী এবং ডাক্তারদের কর্মকাণ্ড এবং নৈতিকতার জন্য জবাবদিহিতা বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করতে পারে, তাহলে সেটাকে আমরা দুর্বলতা হিসেবে দেখবো না'।

তবে এই দম্পতি তাদের এই যাত্রাপথে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিজয় অর্জন করেছেন কারণ গত ২৫শে সেপ্টেম্বর দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আমলের মৃত্যুর তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছে এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালের ও পুলিশের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন।

এই দম্পতির প্রচেষ্টার সুফল মিলতে শুরু করেছে। তদন্তের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট ন্যাশনাল মেডিকেল সেন্টারের পরিচালককে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

এই দম্পতি চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং তারা বিভিন্ন পর্যায় থেকে সমর্থন পাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও তারা শহুরে, ধনী পরিবার হওয়ায় পুলিশ কিংবা মিডিয়ার সুযোগের নাগালে থাকায় সমালোচনার শিকারও হতে হচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন লাখ লাখ পাকিস্তানী আছেন যাদের তেমন কোনো সুযোগ নেই। সূত্র: বিবিসি

ঢাকাটাইমস/১৫অক্টোবর/একে