ছেঁউড়িয়ায় সাধুসঙ্গ শেষ, চলবে মেলা

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১২

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

পূণ্যসেবার মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন আঁখড়াবাড়িতে শেষ হয়েছে সাধুসঙ্গ। ইতোমধ্যেই সাঁইজির আশ্রম ছাড়তে শুরু করেছেন সাধুরা। খেলাফতধারী সাধুরাও ধাম ছেড়ে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন। তিনদিনের লালন স্মরণোৎসবের শেষ পর্যায়ে আঁখড়াবাড়িতে চলছে বিদায়ের সুর।

তবে দূর-দূরান্তের সাধুরা কেউ কেউ বৃহস্পতিবার উৎসব শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। চলবে গ্রামীণ মেলাও।

১২৭ বছর আগে ধরা থেকে দেহলীলা সাঙ্গ করেছেন বাউলিয়ানার শুদ্ধপুরুষ লালন ফকির। মানবধর্মের দিশারী ফকির লালনের দেহাবয়ব নেই দুনিয়ায়, তবে ভক্ত-অনুরাগীদের মননে আজও তিনি জীবিত। তাইতো লালনের তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর তারই আঁখড়াবাড়িতে সমবেত হন দেশ-বিদেশের বাউল-ভক্তরা, আয়োজিত হয় স্মরণোৎসবের। এ বছর সাঁইজির ১২৮তম প্রয়াণবার্ষিকীতে তিনদিনের স্মরণোৎসব শুরু হয়েছে মঙ্গলবার। তিনদিনের আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গ্রামীণ মেলার এ উৎসব শেষ হচ্ছে বৃহস্পতিবার।

বুধবার সকালে রাখালসেবা বা বাল্যসেবার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয়দিনের সাধুদের কার্যক্রম। দুপুরে কলাপাতায় সাদা ভাত, ইলিশ মাছ, সবজি, ডাল এবং দই দিয়ে পূণ্যসেবা গ্রহণ করে চলে যেতে শুরু করেন তারা। সাঁইজির আখড়াবাড়ি ত্যাগের আগে সাধুরা তাদের নিজ নিজ গুরুকে বিশেষ ভঙ্গিতে ভক্তি-শ্রদ্ধা অর্পণ করেন। একজন আরেকজনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখে-চোখে মিলন, পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং হাতজোড় করে বিশেষ ভঙ্গিতে একে অপরকে বিদায় জানান গুরু-শিষ্যেরা। তাদের আবার দেখা হবে দোল উৎসবে।

ফকির নহির শাহ বলেন, ‘এই বিদায়ের মুহূর্তটা আমাদের কাছে সবচেয়ে কষ্টের সময়। এই আশ্রম ছেড়ে আমাদের যেতে ইচ্ছা করে না।’

ফকির নিমাই শাহ বলেন, ‘সাঁইজির এখান থেকে আমরা যা শিখে যাই, তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।’

এর আগে লালন স্মরণোৎসবের প্রথম দিন মঙ্গলবার দুপুর থেকেই আঁখড়াবাড়ির বাউল আঙিনা কানায় কানায় ভরে উঠে। ছোট ছোট করে আস্তানা গেড়ে আসরে আসরে সাঁইজির অমর গান পরিবেশন, তার দর্শন নিয়ে আলোচনা, গুরু-শিষ্যের মিলন ও দীক্ষাগ্রহণে মেতে ওঠেন বাউল ও ভক্তরা। এ ভিড় জনস্রোতে ও সাধুদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সবার সঙ্গে ছিলেন বাউল গানের জীবন্ত কিংবদন্তি কাঙালিনী সুফিয়াও।

উৎসব চলাকালে পুরো মাজার চত্বর একতারা আর ডুগির শব্দে মুখর হয়ে উঠে। সাধুসঙ্গের পর রাতে বাউলেরা অধিবাস ও সাঁইজির আরাধনায় মত্ত হন। সাধুর হাটের সদাই কিনে পরমাত্মায় আত্মা মেলান সাঁইজি প্রেমের রসিকরা। ধূপের ধোঁয়ায় পবিত্র হয়ে উঠে সাঁইজির ধাম। ঢাকের বাড়িতে মন দোলান খ্যাপা-খ্যাপিরা।

গান, দর্শন আর সৃষ্টিতত্ত্বে  লালন মানেই মানুষের জয়গান। মানুষই লালন দর্শনের কেন্দ্র। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি’- এমন ভজনতত্ত¡ অন্য সাধে মেলানো ভার। মানুষেই সৃষ্টি, মানুষেই স্রষ্টা, তা লালনের মতো আর কেউ সহজ করতে বলতে পারেননি এ ধরায়।

আপন আলয়ে ফিরে যাওয়ার আগে তাইতো বাউল আফজাল শাহ বলছিলেন, ‘সাঁইজির দর্শন পেতে এখানে আসা। এখানে এলে মনে-প্রাণের তৃপ্তি পাওয়া যায়। আমরা গুরুদের মুখ থেকে শুনি সাঁইজির বাণী।’

রহমত আলী ফকির বলেন, ‘সাধু-বাউলদের সবাই নাড়ির টানেই আসেন। সাঁইজির ভক্তি করতে পারার সৌভাগ্য কয়জনের ভাগ্যে জোটে? তার প্রেমেই এখানে আসি।’

লালন মাজারের খাদেম মহম্মদ আলী শাহ জানান, তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে এ উৎসব পালনে প্রতি বছর ভক্তরা সমবেত হয়ে থাকেন। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি, আঁখড়াবাড়ি দেশ-বিদেশ থেকে আসা লাখো প্রাণের পদভারে এখন মুখরিত।

সাধুসঙ্গ শেষ হলেও উৎসবের গ্রামীণ মেলা চলবে শেষদিন বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত বলেও জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৭অক্টোবর/প্রতিনিধি/এআর)