মইনুল, মান্নার বক্তব্যে তুমুল সমালোচনা
টেলিভিশন টক শোতে নারী সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে ক্ষেপে গিয়ে তাকে ‘চরিত্রহীন’ বলে গালি দিয়েছেন নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মইনুল হোসেন। অন্য আরেক টক শোতে ফ্রন্টের আরেক নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না দাবি করেন, বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। এই দুই বক্তব্যের পর তুমুল সমালোচনা হচ্ছে ঐক্যফ্রন্টের দুই নেতাকে নিয়ে। এ নিয়ে মইনুল হোসেন চুপ আর মান্না তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন।
মইনুলের বক্তব্য নারী অবমাননাকর এবং মান্নার বক্তব্যকে পাকিস্তান প্রীতি হিসেবে সমালোচনা করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে।
এই বক্তব্যের পর মইনুল কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি, রাজধানীতে একটি আলোচনা সভায় অংশ নিলেও আগের রাতের মন্তব্য নিয়ে কোনো কথা বলেননি। অন্যদিকে মান্না এখনও তার বক্তব্যে অটল। বলে যাচ্ছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে।
তবে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছে দুই জনেরই। মাসুদা ভাট্টিও এই ঘটনায় বিবৃতিতে বলেছেন, “যিনি প্রশ্ন শুনে সাংবাদিককে চরিত্রহীন বলেন, তিনি ‘গণতন্ত্র উদ্ধার’ করবেন!” বলে কটাক্ষ করেছেন।
অন্যদিকে মান্নাকে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে দাবি জানাচ্ছেন শত শত মানুষ। বলছেন, সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে পাকিস্তান প্রেমে মশগুলের কোনো মানে হয় না।
মইনুল যা বলেছেন বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরের টক শোতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বিষয়ে আলোচনা চলছিল। আর লাইভে যোগ দেন মইনুল হোসেন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা গত ১৩ অক্টোবর ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা দেয়ার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পর ফেসবুকে ২০০৫ সালের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে যায়। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, শিবিরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে আর তিনি মনে করেন শিবির দেশ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
মাসুদা ভাট্টি সামাজিক মাধ্যমে উঠা প্রশ্নটিই জানতে চান মইনুলে হোসেনের কাছে। বলেন, ‘ঐক্য ফ্রন্টে আপনি একজন নাগরিক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এটা আপনার দাবি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে, আপনি সেখানে জামায়াতের একজন প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত থাকেন। আসলেই আপনি জামায়াতের প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত থাকেন কি না’।
প্রশ্ন শুনেই ক্ষেপে যান মইনুল। উত্তেজিত কণ্ঠে মাসুদাকে বলেন, ‘আপনার দুঃসাহসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনাকে চরিত্রহীন বলে আমি মনে করতে চাই।’
‘আমার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততার কোন প্রশ্ন নাই। আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, তা আমার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। অন্য প্রশ্ন করেন। শিক্ষিত ভদ্র মহিলা হিসেবে অন্য প্রশ্ন করেন।’
এসময় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানালে মইনুল হোসেন বলেন, ‘আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে জামায়াতের লোক। আপনি সেটা বন্ধ করছেন না কেন?’
সঞ্চালক মইনুলের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাকে জামায়াতের লোক বলা হয়নি। বলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকমটাই বলা হয়ে আসছে’। এসময় মাসুদা ভাট্টি মঈনুলকে বলেন, ‘আপনি শিবিরের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে আপনি বলেছিলেন যে, আপনার সঙ্গে শিবিরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। সে বক্তব্য এখন সব জায়গায় দেখানো হচ্ছে। এ কারণেই এ প্রশ্ন মানুষ করছে যে, আপনি জামায়াতের হয়ে এখানে উপস্থিত থাকছেন কি না।’
এরপর মাসুদাকে মঈনুল প্রশ্ন করেন ‘ আপনি কার প্রতিনিধি হয়ে আসছেন’।
মাসুদা বলেন, ‘কারও প্রতিনিধি হয়ে নয়, আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে এই প্রশ্ন করেছি।’
পরে লাইভে এসে বিকল্পধারার নেতা মাহী বি চৌধুরী মইনুলের আচরণ নিয়ে উষ্মা জানান। বলেন, মইনুল তার বাবার বসয়ী। তার মতো একজন মানুষ যদি এই ভাষায় কথা বলে, তাহলে সেটা জাতির জন্য লজ্জার।পাকিস্তানের প্রশংসায় মান্না অন্য একটি টেভিলিশনের টকশোতে এসে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো বলে বক্তব্য রাখেন নাগরিক ঐক্যের প্রধান এবং ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না।
বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বলে বহুল ব্যবহৃত বাক্যাংশকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে মান্না বলেন, ‘বাংলাদেশ কোন দেশের রোল মডেল বলেন তো? পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো। যাকে আমরা সবচাইতে সমালোচনা করি।’
মান্নার এমন মন্তব্যে বিষ্ময় প্রকাশ করে সঞ্চালক বলেন ‘পাকিস্তানের অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো?’
মান্না বলেন, ‘হ্যাঁ, ডেফিনেটলি। তাদের গ্রোথ ইয়ে টিয়ে সব দিক থেকে অনেক বেশি স্টেবল এবং তাদের ইনস্টিটিটিউশনগুলো অনেক বেশি স্টেবল।’
ওই আলোচনাতেই বাংলাদেশের মতো হতে চেয়ে পাকিস্তানের টক শো গুলোতে আকুতির কথা জানান সঞ্চালক এবং অপর আলোচক জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান। তবু মান্না তার বক্তব্য থেকে সরতে চাননি।
ঢাকাটাইমসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘হ্যাঁ আমি বলেছি কোন কোন জায়গায়, আমাদের বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে পাকিস্তান, এটা বলেছি। আমি মনে করি না বাংলাদেশের অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো।’
আপনারা এই বক্তব্যের তো ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে- এমন মন্তব্যে মান্না বলেন, ‘আমি এখনও জানি না কী সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনাগুলো আমার কাছে আসুক, তারপর সেই সমালোচনার জবাব দেব।’
মইনুলকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি
মইনুল ও মান্নার বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তীব্র। মইনুলকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম নামে একটি সংগঠন।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় বলেন, ‘টকশোর সম্মানিত আলোচক মাসুদা ভাট্টিসহ গোটা সাংবাদিক সমাজের বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ ও ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ করে মন্তব্য করার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে-যা শিষ্টাচার বহির্ভূত। আমরা তার এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করছি এবং সেইসাথে তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে মাসুদ ভাট্টিসহ সাংবাদিক সমাজের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান করছি।’প্রতিবাদ জানিয়েছেন মাসুদা ভাট্টি নিজেও। গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে তিনি মইনুলের কাছে সাতটি প্রশ্ন রেখেছেন। জানতে চেয়েছেন বাবা তফাজ্জল হোসেন মাণিক মিয়া বেঁচে থাকলে তিনি কী করতেন।
মইনুল হোসেনরা ক্ষমতায় আসলে নারীদের অবস্থান কী হবে, সে নিয়েও শঙ্কিত মাসুদা। বলেছেন, ‘ড. কামাল হোসেনের মতো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির পাশে এরকম একজন ভয়ঙ্কর ব্যক্তিকে কী মানায়? এদের সঙ্গে মিলে ড. কামাল হোসেন কী গণতন্ত্র দেবেন আমাদেরকে? চরিত্রহীন বলার গণতন্ত্র?’।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রভাষ আমিন ফেসবুকে লেখেন, ‘যিনি ছাত্রশিবিরের অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দেন, তাকে জামায়াতের প্রতিনিধি মনে করাটা অন্যায় নয়। তিনি বলতে পারতেন, আমি জামায়াতের প্রতিনিধি নই। কিন্তু সরাসরি টক শো'তে একজন নারীকে গালি দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি ব্যারিস্টার মইনুলের শাস্তি চাই। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের সঠিক প্রয়োগ চাই।’
আরেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক গাজী নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মইনুল হোসেন মাসুদা ভাট্টিকে যা বলেছেন তা যৌন হয়রানির সমতুল্য। তার শাস্তি দাবি করছি।’
‘মান্নার পাকিস্তানপ্রীতির প্রমাণ’ মান্না টক শোতে যা বলেছেন, তাকে তার পাকিস্তানপ্রীতির প্রমাণ হিসেবেই দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোবিন্দ চক্রবর্তী। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতে এটা একটা বড় সমস্যা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন অনেককেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এ মানদ- সরকারের তৈরি না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোই এটা তৈরি করে। এ কাজে তারা সরকারের কাছে কোন সহযোগিতা চায় না। মান্নার এ বক্তব্য পাকিস্তান প্রীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ’
‘মান্না সাহেবরা জামায়াত ইস্যু সুরাহা না করে যেভাবে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছে, সেক্ষেত্রে তার মুখ থেকে পাকিস্তান প্রীতি ছাড়া আর কী বেরুবে?’।
ঢাকাটাইমস/১৭ অক্টোবর/আরকে/জিএম/ডব্লিউবি