শরিক যায়, সংখ্যায় ঠিক থাকে ২০ দল
প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:১২
গত আড়াই বছরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে পাঁচটি দল। ভেঙেছে আরও বেশ কিছু শরিক দল। কিন্তু সেটি ১৫ দলীয় জোট হয়নি। এখনও ২০ দলীয় জোটের পরিচিতি ধরে রেখেছে সেটি।
এর আগেও যখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ছিল, সেখান থেকেও একটি দল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার পরও জোটে দলের সংখ্যা একই থাকে।
প্রতিবারই একই কৌশল নেয় বিএনপি। যে দলটি বের হয়ে যায়, সেটির এক নেতাকে জোট ত্যাগ করা নেতাকে বহিষ্কার করে একই নামে আরেকটি দল থেকে যায় জোটে। ফলে সংখ্যার দিক থেকে জোটে কমতি হয় না।
এমনিতে ২০ দলে যেসব শরিক আছে, তার মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী আর অলি আহমেদের এলডিপি ছাড়া বাকিগুলোর জনভিত্তি নেই বললেই চলে। কোনো নির্দিষ্ট আসনেও তাদের তেমন শক্তি নেই। তবুও জাতীয় রাজনীতিতে জোটের কারণেই তারা আলোচনায় থাকেন।
এই দলগুলোর মধ্যে কেউ জোট ছাড়লে তাতে জোটের শক্তিক্ষয় সেভাবে হয় না। তবুও জোটে ভাঙন ঠেকাতে একই নামে নতুন দল সৃষ্টিতে কেন আগ্রহ, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ বিএনপিতেই। তবে এটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন একজন কেন্দ্রীয় নেতা। যদিও তিনি জানেন না এটা কেন হয়।
যেসব শরিক হারিয়েও হারায়নি বিএনপি
সবশেষ বিএনপি শরিক হারিয়েছে সোমবার। ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য মিলিয়ে গঠন করা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আপত্তি জানিয়ে ২০ দল ছেড়েছে বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি।
এর আগে ২০১৪ সালে প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নিলুর ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির জোট ছাড়ার মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন শুরু হয়। কিন্তু পরক্ষণেই ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে এনপিপি নামেই একটি অংশ বিএনপি জোটে যুক্ত থাকে।
সে সময় এনডিপির একাংশ নিলুর সঙ্গে ২০ দলীয় জোট ছাড়ে। তখন আবার মহাসচিব আলমগীর মজুমদার এবং চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তাজার মধ্যে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার চলে। আলমগীর মজুমদার জোট ছেড়ে যান, খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ২০ দলীয় জোটে থেকে যান।
২০ দলীয় জোটের শরিক ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবদুর রশিদ প্রধানও নিলুর সঙ্গে জোট ছাড়েন। তবে চেয়ারম্যান আবদুল মোবিনের নেতৃত্বাধীন দলটি থেকে যায় জোটে।
একই বছর ২০ দলীয় জোট ছাড়ে শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে ভাসানী ন্যাপ। কিন্তু এর পরেই আবার তৈরি হয় ভাসানী ন্যাপের ভঙ্গাংশ। এবার নেতা হন আজহারুল ইসলাম।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জোট ছেড়ে যায় ইসলামী ঐক্যজোট। প্রয়াত নেতা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর এই দলটির ২০ দল ছেড়ে যাওয়া অবশ্য বিএনপির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ, এই দলটি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক; এসব মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা বিএনপির হয়ে নির্বাচনে আর একাট্টা হয়ে ভোটের প্রচারে নামবে না-এটা নিশ্চিত।
তবে যেদিন ইসলামী ঐক্যজোট বেরিয়ে যায়, সেদিন এর এক নেতা আবদুর রকিবকে দিয়ে দলের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী এবং মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহকে বহিষ্কার করানো হয়। আর রকিব ইসলামী ঐক্যজোট নামেই দল নিয়ে থেকে যান বিএনপিতে। যদিও রকিবের দলের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে প্রভাব আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের এক সময়ের নেতা ছিলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক। ১৯৯৯ সালে তার নেতৃত্বেই বিএনপি, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী মিলে গঠন করা হয় চারদলীয় জোট।
২০০৬ সালে আজিজুল হক চারদলীয় জোট ছেড়ে যাওয়ার পর মুফতি আমিনী ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা হিসেবে থেকে যান চারদলীয় জোটে।
অর্থাৎ যে দল জোট ছেড়েছে তাদেরই একটি অংশ জোটে থাকার ঘোষণা দিয়ে ২০ দলের সংখ্যা ঠিক রেখেছে! যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে হাস্যরসেরও সৃষ্টি হয়েছে নানা সময়।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এভাবে দলের ভগ্নাংশ তৈরি করা রাজনীতির জন্য ভালো নয়। তবে এ নিয়ে দলের হাইকমান্ড বলতে পারবে। তারাই ভালো জানেন।’
ন্যাপ-এনডিপির ভগ্নাংশ নিয়ে লেজেগুবড়ে অবস্থা
মঙ্গলবার ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় জেবেল রহমান গানির বাংলাদেশ ন্যাপ ও খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার এনডিপি। কয়েক ঘণ্টা পরই দুই শরিকদের একাংশের পক্ষ থেকে বিএনপির সঙ্গে ২০ দলে থাকার কথা জানায়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই দুই দলের মধ্যম সারির পদধারী নেতারা জোটে থাকার কথা জানান। একইসঙ্গে জোট ছেড়ে যাওয়া দলের চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবদেরও বহিষ্কার করেছেন নতুন নেতারা।
আবার এনডিপির ভগ্নাংশের পক্ষ থেকে যাকে নেতা জানানো হয়েছে, তার সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো নেতার নাম এক নয়। এ নিয়েও আছে হাস্যরস।
সংবাদ সম্মেলন করে এনডিপি জোট ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা পর দলের প্রচার সম্পাদক দাবিদার জিয়াউল হকের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘২০ দলীয় জোট পরিপন্থী কাজে যুক্ত হওয়ায় দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা এবং মহাসচিবের পদ থেকে মঞ্জুর হোসেন ঈসাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মো. মুত্তাকিম হোসেনকে এনডিপির নতুন চেয়ারম্যান এবং ওসমান গণিকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়েছে।’
এর কিছুক্ষণ পরই এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা এবং মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসা গণামাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠান। তাতে বলা হয়, ‘দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করায় এবং দলের শৃঙ্খলাপরিপন্থী থাকায় প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. মুত্তাকিম হোসেনকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। দলের সাধারণ সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’
তবে এনডিপির নেতা হিসেবে আবার আরেক জনের নাম জানিয়েছে বিএনপি। দলটির দপ্তর থেকে বুধবার দুপুরে রিজভী আহমদের সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে আলাদা মেইলে এনডিপির নতুন সভাপতি হিসেবে আবু তাহেরের নাম উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এনডিপির ২২টি জেলার সভাপতি বৈঠক করে তাকে নতুন সভাপতি ঘোষণা করেছেন।
অন্যদিকে এম এন শাওন সাদেকী বাংলাদেশ ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দাবি করে চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি এবং মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূইয়াকে বহিষ্কার করে বসেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, তার দল ২০ দলের সাথে সাথে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
২০ দলের আরেক শরিকের মধ্যে ভাঙন ধরেছে। একই নামে ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। তবে দুই ভাগই আবার বিএনপির জোটে আছে।
জোটে এমন ভাঙা গড়ায় কোনো প্রভাব পড়বে না দাবি করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থে দুই-একজন চলে গেলেও ২০ দলে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কোনো কোনো নেতা লোভের জন্য বেইমানি করছেন। তবে ২০ দল ভাঙছে না।’
(ঢাকাটাইমস/১৮অক্টোবর/বিইউ/ডব্লিউবি)