কত বড় শিল্পী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০৬ | প্রকাশিত : ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:১৯

আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চা লাখো কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, কয়েক যুগ ধরে গিটার আর গলার জাদুতে মানুষকে সম্মোহিত করেছেন। যত দিন পৃথিবী থাকবে, পৃথিবীর মানুষ থাকবে তত দিন আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনবে মানুষ। অসাধারণ সব গান শুনে মানুষ হয়তো ভুলে যাবে যে আইয়ুব বাচ্চু আর পৃথিবীতে নেই, মানুষ আইয়ুব বাচ্চুকে জীবিতই মনে করবে। গুণী মানুষ এমনই। মরেও তাঁরা জীবিত থাকেন নিজের কর্মে।

আইয়ুব বাচ্চু কত বড় শিল্পী ছিলেন? বিদেশের যেকোনো বিষয়ে মুগ্ধতা আমাদের স্বভাবে। কেউ লিখছেন, আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রক স্টার, কেউ লিখছেন বাংলা ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি, কেউ কেউ অবশ্য আরেকটু সাহস করে বলছেন যে, উপমহাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী।

বিশ্বের সব বড় শিল্পীকে তো আমরা চিনি না। তাহলে তুলনা করব কীভাবে? সব শিল্পীর গান হয়ত শোনা হয় না। কিন্তু অনেক গান তো আমরা শুনি। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ভাষার নানা কিসিমের গান আমরা শুনি। অনেক শিল্পীর স্টুডিও এবং কনসার্টের পারফরম্যান্স আমরা দেখেছি। বিশেষ করে ইউটিউব আসার পর থেকে পুরো বিশ্বের সংগীত খুব সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। কোনো সংগীত বিশেষজ্ঞ নয়, একজন সাধারণ শ্রোতা হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুকে মূল্যায়নের একটু দুঃসাহসিক প্রয়াস এই লেখা।

আইয়ুব বাচ্চু গান না গেয়ে যদি শুধু গিটার বাজাতেন, তাও মনে হয় বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান গিটারিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। আইয়ুব বাচ্চুকে গিটার বাজাতে দেখে বাংলাদেশসহ নানা দেশের কত মানুষ গিটার শিখতে চেয়েছে, শিখেছে তার হিসেব কেউ কোনো দিন জানবে না। গিটার হাতে মাথায় ক্যাপ পরা আইয়ুব বাচ্চু যখন মঞ্চে সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করতেন, তখন কী এক অনবদ্য আকর্ষণীয় আবহ সৃষ্টি হতো চারপাশে সেটি কেবল তাঁর কনসার্ট দেখার সৌভাগ্য অর্জনকারীরাই বলতে পারবে।

বাংলা গান আসলে কেমন? পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, গণসংগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি নানা কিসিমের মধ্যে বাংলা ব্যান্ড সংগীত বিশেষ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমা পপ মিউজিকের ধাঁচে বাংলায় ব্যান্ড সংগীতের জন্মদাতাদের একজন আমাদের প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু। পশ্চিমা পপ মিউজিকের অনিবার্য অগ্রযাত্রাকে যারা নিজের ভাষা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, স্বপ্ন, অনুভূতির শক্তিকে সজীব রেখে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁদের অগ্রভাগে আজীবন ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন আইয়ুব বাচ্চু। একই সাথে বাঙালি, আবার একই সাথে যেন আন্তর্জাতিক। গ্রাম আর শহরের জীবনের টানাপোড়েনের মিশেলে সৃষ্ট বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের কষ্ট, অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা, অভিমান, বিরহ, হাহাকার, স্বপ্ন, শহুরে বাউলিয়াপনাকে ব্যান্ডের তালে তালে যে কয়জন বাঙালি ব্যান্ড স্টার পপ মিউজিকের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সাফল্যের সাথে তুলে ধরতে পেরেছেন, সর্বকালের ইতিহাসে আইয়ুব বাচ্চু তাঁদের শীর্ষে থাকবেন এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট আইয়ুব বাচ্চু জন্মেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চট্টগ্রামে। তিনি শুধু গিটার বাজাতেন বা গান গাইতেন, তা নয়। তিনি গান লিখতেন এবং সুরও করতেন। জীবন-মৃত্যুর নানা দর্শন তাঁর গানের কথায় প্রকাশ পেয়েছে। ‘রুপালী গিটার ছেড়ে, একদিন চলে যাব দূরে, বহু দূরে’ কিংবা ‘আরও বেশি কাঁদালে, উড়াল দেব আকাশে’ কিংবা ‘এক পুরুষে গড়ে ধন, এক পুরুষে খায়’ জাতীয় গানে তাঁর গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

এলআরবির মূল শিল্পী হয়ে আত্মপ্রকাশ করার আগে আইয়ুব বাচ্চু দশ বছর সোলস ব্যান্ডের সাথে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সংগীতজগতে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ফিলিংসের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে। শ্রোতা-ভক্তদের কাছে আইয়ুব বাচ্চু সংক্ষেপে এবি (AB) নামেও পরিচিত। খুব কাছের মানুষ তাঁকে ‘রবিন’ নামেও চিনত। বাচ্চুর সংগীতজগতে যাত্রা শুরু হয় ফিলিংস ব্যান্ডের সাথে ১৯৭৮ সালে। তাঁর কন্ঠ দেয়া প্রথম গান "হারানো বিকেলের গল্প"। গানটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি সোলস ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত রক্তগোলাপ আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ময়না (১৯৮৮)-এর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে বাচ্চু এলআরবি ব্যান্ড গঠন করে। এই ব্যান্ডের সাথে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম এলআরবি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে।

শখের বশে আইয়ুব বাচ্চু অভিনয়ও করতেন। ২০১০ সালে ঈদের জন্য নির্মিত ট্রাফিক সিগন্যাল ও হলুদ বাতি শিরোনামের নাটকে অভিনয় করেন। ছোট লেখায় আইয়ুব বাচ্চুকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। একজন বাংলাদেশি বাঙালি কী পরিমাণ স্মার্ট, গুণী হতে পারেন আইয়ুব বাচ্চু তার অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আইয়ুব বাচ্চু শুধু বাংলাদেশের বা এই উপমহাদেশের স্টার ছিলেন না। তিনি একজন আন্তর্জাতিক স্টার। মাইকেল মধুসূদনের মতো বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে আশ্রয় খুঁজেননি আইয়ুব বাচ্চু। আইয়ুব বাচ্চু বাংলা ও বাঙালিত্ব দিয়েই এমন সব গান আর স্টেজ পারফরম্যান্স দিয়ে গেছেন যা দেখে ও শুনে বিশ্বের যেকোনো ভাষার মানুষ আলোড়িত হবে। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে বাংলাদেশ তাই নিজের একজন আন্তর্জাতিক তারকাকে হারাল। এক অমূল্য সম্পদকে হারাল বাংলাদেশ।

শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বড়ত্ব আমাদের কাছে প্রকাশিত। মানুষ হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু কেমন ছিলেন? অচেনা মানুষের সাথে আইয়ুব বাচ্চুর মতো তারকা কেমন আচরণ করতেন, তার একটা উদাহরণ দিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক আকবর হোসেন। আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে বিবিসির সাংবাদিক আকবর হোসেন নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এই পোস্ট পড়লেই বোঝা যাবে, মানুষ হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু আরও কত বড় ছিলেন!। আকবর হোসেন লিখেছেন, “ প্রায় ১০ বছর আগে আইয়ুব বাচ্চুর সাথে একই লিফটে উঠেছিলাম। সে লিফটে আরও ৫-জনের মতো ছিলেন। সবাই একে অপরের সাথে পরিচিত নয়। শুধু আইয়ুব বাচ্চুকে সবাই চেনে। লিফটে ওঠার পর আইয়ুব বাচ্চু নিজ থেকে সবার সাথে পরিচিত হলেন। তিনি বললেন, ‘এই যে লিফটের ভেতরে আমরা সবাই বাঙালি। সবাই বাঙলা ভাষায় কথা বলি। কিন্তু লিফটে ওঠার পর মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। একজন আরেকজনের সাথে কুশল বিনিময় করে না। বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগে না। সেজন্য আমি লিফটে উঠলে সবার সাথে কুশল বিনিময় করি। আপনারা কিছু মনে করবেন না। বিষয়টি খুবই ছোট। কখনো সেভাবে খেয়াল করিনি। আইয়ুব বাচ্চু দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কুশল বিনিময় করতে সব সময় পরস্পরের পরিচিত হতে হয় না।

১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে, তখনই বাংলাদেশ নয় শুধু, পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন বাংলা ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। একজন আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন যুগস্রষ্টা। কয়েকটি প্রজন্মের আইকন ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এমন একজন মানুষ আবার কবে পাবে বাংলাদেশ, কে জানে।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :