ড. কামালের সতীর্থ কাহন

প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৪৫

আলম রায়হান

ড. কামাল হোসেনের নতুন মিশনের প্রধান সতীর্থ হিসেবে দৃশ্যমান ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না। এদের মধ্যে একমাত্র ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দলীয় ভিত্তি আছে; বিএনপি। বাকি সবাই কেবলই ব্যক্তি। তাদের কোনো দল নেই। আ স ম আবদুর রবের এক সময় বড় দল ছিল, এখন আছে কেবল সাইনবোর্ড। মহাযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের নায়ক ড. কামাল হোসেনের সতীর্থদের বিচার-বিশ্লেষণ একটি রুটিন ব্যাপার।

মানিক মিয়ার সন্তান হিসেবে ব্যরিস্টার মঈনুল হোসেন পরিবারিকভাবে খুবই পরিচিত ও প্রভাবশালী। আইন পেশায়ও তার শক্ত অবস্থান রয়েছে। এ পেশার নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি; লেখেন ভালো, বলেনও ভালো। এক সময় রাজনীতির কমিটমেন্টের বিষয়ও তিনি দৃঢ়চেতা ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো পাহাড়-প্রমাণ নেতার সামনে দাঁড়িয়ে বাকশালের বিরোধিতা করতে পেরেছিলেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সাহসের চেয়ে হয়তো তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্নেহ বেশি কাজ করেছে। এরপরও বলতে হয়, তিনি সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু এই সাহস তিনি তার অন্তরের বিশ্বাস থেকে দেখিয়েছেন নাকি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষে ১৫ আগস্টের থিংকট্যাংকের ক্রীড়নক হিসেবে করেছেন তা অবশ্য গভীর গবেষণার বিষয় হয়েই থাকলো। এরপরও সাধারণভাবে তাকে রাজনীতিতে দৃঢ়চেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এই ইমেজ হারিয়েছেন ওয়ান ইলেভেন সরকারে যোগ দেয়ার পর। এ ঘটনায় তার ইমেজ ধুলায় লুটোপুটি খেয়েছে। সেখান থেকে তিনি আর উঠে আসতে পারেননি এখনও। সে সময় দুর্নীতির রুই-কাতলা ধরার দায়িত্ব নিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন।

উল্লেখ্য, ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার অভিযানের জন্য গঠন করা হয়েছিল ‘গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি।’এর প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। শুধু তাই নয়, ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় দুই নেত্রী মাইনাস ফর্মুলার রূপকার হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এই দুজনকে। আর যে মামলার রায়ে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে সেই মামলা করার ক্ষেত্রে দুদককে প্রভাবিত করার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। কাজেই আর যাই হোক, বিএনপির নিবেদিত প্রাণ কর্মী-সমর্থকদের আস্থা কখনো অর্জন করতে পারবেন না ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের। এ অবস্থায়ই তিনি দাঁড়িয়েছেন ড. কামাল হোসেনের পাশে। আর ড. কামালের দৃশ্যমান রাজনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে বিএনপি।

নতুন মিশনে ড. কামালের সক্রিয় সতীর্থ হিসেবে বেশ সক্রিয় আ স ম আবদুর রব। তিনি বেশ সরবও। এতটাই সরব যে, যখন বি চৌধুরী তার বাসায় সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তখন প্রেসক্লাবে জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে আ স ম রব বলছেন, ‘তিনি অসুস্থ বলে আসতে পারেননি।’ সংবাদ  সম্মেলনে ড. কামাল যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানের বন্দিদশার স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন তখন প্রায়ই লিংক ধরিয়ে দিয়েছেন আ স ম আবদুর রব; যেন তিনি সঙ্গে ছিলেন! মিথ্যাচার এবং মানুষকে বোকা বানাবার অপকৌশল আর কাকে বলে!

সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক রাজনৈতিক চরিত্র আ স ম আবদুর রব। ডাকসু নেতা থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নেতা হিসেবে রাজনীতির ঊর্ধ গগন থেকে ৭৫ পরবর্তী সময়ে পতিত হয়েছেন তিনি। এমনকি পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে একটি চাকরিও খুঁজেছিলেন। তবে তিনি এরশাদ সরকারের সময় অনেকটা চাকরিগোছেন একটি কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি কয়েকটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল নিয়ে ‘কপ’নামে একটি জোট গঠন করেন। এর ধারাবাহিকতায় ৮৮ সালের সংসদে তিনি হন বিরোধী দলের নেতা। তবে এ পদে তার মেয়াদকাল ছিল মাত্র দুই বছর। ৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হলে আ স ম আবদুর রব আবার রাজনৈতিক দুর্দশায় পড়েন।

তবে তার এ দুর্দশা কেটে যায় ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আ স ম অবদুর রব। তার মন্ত্রী হবার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল আবদুল আউয়াল মিন্টুর। ’৯৬-এর সংসদের মেয়াদ শেষে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের অবসান হয়; একই সময় আ স ম আবদুর রব উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেন। এটি তার জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। তবে এর আগেই এক মেয়াদে মন্ত্রী থাকাকালেই উত্তরার রাজকীয় বাড়িসহ বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন তিনি। জেনারেল এরশাদের রাবার স্টাম্প পার্লমেন্টের বিরোধী দলের নেতা এবং শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী আ স ম আবদুর রব এখন দাঁড়িয়েছেন ড. কামালের পাশে। লক্ষ্য বিএনপির জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলা।

ড. কামাল হোসেনের প্রধান সতীর্থদের আর একজন হচ্ছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। চাকসু নেতা হিসেবে রাজনীতির গগনে দৃপ্ত পদচারণা শুরু হয় মাহমুদুর রহমান মান্নার। এরপর ডাকসু নেতা হিসেবে তিনি হয়ে যান ছাত্র রাজনীতির তারকা। আজকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ডাকসু নির্বাচনে নিদারুণভাবে পরাজিত হয়েছেন এই মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা হিসেবে তিনি এতই উজ্জ্বল ছিলেন যে, জেনারেল জিয়াও তাকে পাশে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আর এক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ নিয়মিত মান্না-আকতারের দুয়ারে ধর্না দিতেন দলে টানার জন্য। কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে প্যানেলের তৃতীয় নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বগলদাবা করেন জেনারেল এরশাদ। প্রথমে তাকে করা হয় প্রেসিডেন্টের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা, অফিস দেয়া হয় গণভবনে। পরে জনাব বাবলুকে উপ-মন্ত্রী এবং ফুল মন্ত্রী করা হয়েছে। অবশ্য তার এই উত্থানের পেছনে নানান রকমের রসালো রটনা আছে।

এদিকে দুই সামরিক শাসকের প্রলোভন উপেক্ষা করতে পেরেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ছাত্ররাজনীতির জীবন শেষে গার্মেন্টস ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন তিনি। এর বেশ কিছু পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মাহমুদুর রহমান মান্না। এবং পেয়ে যান সম্মানজনক পদ। কিন্তু শেষতক আওয়ামী লীগে থাকেননি। কেন থাকেননি? অনেকের মতে, এ এক রহস্যজনক বিষয়। তাদের মতে চাকসুর জিএস যে লবিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হয়েছিলেন ডাকসুর ভিপি সেই একই লবিং মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আওয়ামী লীগে রাখতে চায়নি।

উল্লেখ্য, ডাকসুর ভিপি থাকাকালে জাসদ ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হবার পর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে পিনপতন স্তব্ধতায় ৭৫ মিনিট বক্তৃতা দিয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। যা ব্যানার লিড আইটেম করেছিল সাপ্তাহিক জনকথা। এ ইভেন্ট কাভার করার জন্য পত্রিকাটির প্রকাশের সিডিউল এক দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমেনা বেগমের মাধ্যমে এই সাপ্তাহিক জনকথায় অর্থায়ন করতেন বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক।

এই হচ্ছে বিশাল এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ড. কামাল হোসেনের সতীর্থদের কাহন! তার আর এক সতীর্থ হতে পারতেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি পিছুটান দিয়েছেন। তবে অনেকেই মনে করেন, আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর আগেই অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী উল্টো পথে হাঁটায় অনেকটা শাপেবর হয়েছে ড. কামালের জন্য।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এক খানকায় দুই পীরের জটিলতার বাইরেও ড. কামাল-বি. চৌধুরীর টেকসই ঐক্যের ক্ষেত্রে বড় জটিলতা হচ্ছেন বি. চৌধুরী তনয় মাহি বি. চৌধুরী। বলা হয় মাহির কারণেই কর্নেল অলির সঙ্গে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জোট টেকেনি। তারা যখন ঐক্য ভেঙে বেরিয়ে যান তখনও তাদের প্রতি বিএনপির বৈরী আচরণের ঘা ছিল দগদগে। কর্নেল অলি ছিলেন জামায়াতের প্রভাবে মন্ত্রী না হতে পারার বেদনায় কাতর এবং বি. চৌধুরী ছিলেন রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিতারিত হবার বেদনায় মুহ্যমান। পদ হারানো কেবল নয়, সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতিকে বন্ধ রেল লাইন পেরিয়ে পালাতে হয়েছিল বিএনপির রাজত্বে। এ বেদনা ভুলেও তিনি বিএনপি প্রভাবিত ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন। এ ক্ষেত্রে তার প্রধান বক্তব্য হচ্ছে, এককভাবে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া যাবে না।

অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী হয়তো বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন। অথবা শেষ মুহূর্তে কেবলা বদলের বিনিময়ে ক্ষমতাসীন জোটের কাছ থেকে কিছু পেয়েছেন, অথবা আশা করছেন। নিজের জন্য না হোক, ছেলের জন্য হলেও আশার ফাঁদে ধরা দিয়ে থাকতে পারেন তিনি। অবশ্য এ রকম প্রাপ্তির আশা করেছিলেন বিএনপির আর এক প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা কর্নেল অলি আহমেদ। কিন্তু তিনি হতাশ হয়েছেন। কর্নেল অলি পেয়েছিলেন সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের পদ। যদিও সূত্রমতে তিনি আশা করেছিলেন মন্ত্রিত্ব, যা জোটেনি। ফলে তিনি ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন।

ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে প্রাপ্তির আশায় কেবল যে কর্নেল অলি-বি. চৌধুরী হাঁটেন তা কিন্তু নয়। এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়ে এ পথে পা বাড়িয়েছেন জেবেল রহমান গানি ও খোন্দকার গোলাম মোর্তুজা। আর এ ধরনের হাঁটাহাঁটির ধারা শুরু হয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়। যা দুই কান কাটা ব্যক্তির মতো নির্লজ্জ অবস্থানে পৌঁছায় জেনারেল এরশাদের সময়। এ ধারা কম-বেশি বজায় থেকেছে পরবর্তী নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের সময়ও। কিন্তু এ ধারা হাসিনা-খালেদা সরকারের সময় তেমন জোরালো ছিল না। এ ধারায় পালে আবার জোর হাওয়া লেগেছে বলে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে। ফলে ডোবার ব্যাঙের মতো অনেক নেতার লাফালাফি দেশবাসী দেখবে নির্বাচনকে সামনে রেখে।

কাজেই অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও জেবেল রহমান গনির কেবলা বদলে অবাক হবার কিছু নেই। যদিও বি. চৌধুরী ছিলেন জেনারেল জিয়ার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এবং জেবেল রহমান গানি হচ্ছেন জিয়ার আরেক দোসর মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নাতি। জেবেল রহমান গানির বাবা সফিকুল গানি স্বপনও আওয়ামী রাজনীতির বিরুদ্ধ অবস্থানে ছিলেন আমৃত্যু, তার বাবার মতো। নতুন প্রজম্মের জেবেল রহমান দাদা ও বাবার রাজনৈতিক ধারার উল্টো পথে হাঁটলে নিশ্চয়ই বেশি দোষ দেয়া হয়তো ঠিক হবে না।

উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়ার সময় মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মৃত্যু নিয়ে গভীর রহস্য রয়েছে।

আলম রায়হান: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক