হাজারো বেদনার কথা নীরবে বলে যায় ছবি

প্রকাশ | ২০ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৫৩

ইফতেখায়রুল ইসলাম

অফিসের উদ্দেশে যাচ্ছিলাম, সিগন্যালে আটকে গেল গাড়ি। এদিক-ওদিক তাকাতেই হঠাৎ চোখে পড়লো একটি দুর্লভ দৃশ্য! একমনে তাকিয়েছিলাম, এক মা তার ছেলে সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বাচ্চাটি বারবার ছুটে যেতে চাইছে কিন্তু মা তাকে ছাড়ছেন না।

ব্যস্ত রাস্তার পাশে এ সকল দৃশ্য দুষ্প্রাপ্যই বটে। পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত ছোট্ট ছেলেটি তার মায়ের এই অকৃত্রিম ভালবাসাটুকু অনুধাবন করার সুযোগও পাচ্ছে না। তার শারীরিক অবয়বে এক ধরণের অনাগ্রহ দৃশ্যমান ছিল।

মাঝে মাঝে জ্যাম বিরল কিছু দৃশ্যের মুখোমুখি করে দেয়! এটা কারো দৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক ও সাধারণের কাতারে এলেও আমি এই ছবিকে মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসার এক শক্তিশালী চিত্র হিসেবেই দেখছি।

ছবিটি দেখার পর মুহূর্তেই আমার মনে একটা দৃশ্য অনুরণিত হলো; আমি দেখলাম ওই ছবির বসে থাকা ছেলেটি ইফতেখার আর মা জননী তারই মা সালেহা বেগম! ভাবনার অতল গহ্বরে যেতে না যেতেই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় টপটপ বৃষ্টি পড়তে থাকলো।

ভাবনায় মা এলে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত মানুষটিও দুর্বল হয়ে যায়, ভেঙে পড়ে! এটি তো হওয়ার নয়, মা তো পরপারে। এই একটি দৃশ্যে আমার বারবার ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল। যদি কিছুই না থাকতো তবুও যদি মা থাকতো! না হয় দিনমজুরের মত খেটেই মাকে খাওয়াতাম, শিক্ষিত নাইবা হতাম! তাও তো আমার মা থাকতো! পথে ঘাটে ফেরি করে বেড়িয়ে, পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব মানুষটি হয়েও যদি মাকে ফিরে পাওয়া যেত তবে আমি তাই বেছে নিতাম!

পৃথিবীর প্রত্যেক মায়েরই গল্প থাকে। আমাদের সমাজে সন্তানের হন্তারক হিসেবে যে নারীদের আমরা দেখতে পাই। তারা কখনোই মা নন! মা-তো তারাই যারা দিন রাত গাধার খাটুনি খেটে সন্তানকে প্রতিপালন করেন! পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন, তাৎপর্যপূর্ণ ও ধন্যবাদহীন চাকরিটা করেন আমাদের মায়েরা এবং তারপর সবচেয়ে বেশি কথা শোনেন এই মায়েরাই।

যে সন্তান তার হৃদয়ের ব্যথা নিয়ে মায়ের কাঁধে মুখটি রেখে প্রাণ খুলে কাঁদতে পারে না, যে সন্তান মায়ের হাতে মাখা একটু ভাত মুখে নিতে পারে না, যে সন্তান সারাক্ষণ গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত মায়ের কাপড়ে ঘামের মিশেলের সোঁদা গন্ধটুকু প্রাণভরে নিতে পারে না, যে সন্তান ক্রন্দনরত মায়ের চোখটুকু মুছিয়ে কপালে চুমু খেতে পারে না, যে সন্তান ঘুমন্ত মায়ের পা দুটো বুকে জড়িয়ে রাখতে পারে না, যে সন্তান অসুস্থ মায়ের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে থাকার, পাশে থাকার অনুভূতিটুকু দিতে পারে না, সেই সন্তানের চেয়ে দূর্ভাগা সন্তান এই পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না।

কেউ কেউ পাগলের মত মাকে ভালবাসে, মাকে চায়, তাদের মা হারিয়ে যায়, বেঁচে থাকে না! আর যে সন্তান মায়ের খোঁজটুকুও রাখে না, মাকে মাথার বোঝা মনে করে তাদের মায়েরা বেঁচে থাকে এক বুক বেদনা নিয়ে।

কাঁপা কাঁপা হাতে যে মা তার সন্তানের মুখটুকু ছুঁতে চায়, তাঁর জায়গা মেলে বৃদ্ধাশ্রমে! নিজের মায়ের কাঁপা কাঁপা হাতের ভরসার কাঁধ হওয়ার আগেই মাকে হারিয়ে ফেলেছি! হারিয়ে যাওয়ার আগেই হয়ে উঠুন না আপনার মায়ের একমাত্র অবলম্বন! কেন ময়লা কাপড়, ভাঙা চশমা পড়ে আমাদের মায়েরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন বলুন তো? আপনার সারাজীবনের অবদানও তো মায়ের কাছে তুচ্ছ! বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় মা বাবাকে দেখলে আমরা অনেকেই ঠিক থাকতে পারিনা! আপনারা পারেন কি করে? বুকের ভেতরটা কি বাজে না?

যে মা নিজের সমস্তটা বিসর্জন দিয়ে আপনাকে গড়ে তুললেন তাকে বাদ দিয়ে নিজের পৃথিবী রচনা করছেন এই আপনার, আমার মাঝেরই কেউ কেউ! তাকে কি পৃথিবী আদৌ বলা যায়? সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি! আপনার স্বর্গ আপনার ঘরেই, নিজের বাবা মাকে উজাড় করে ভালবাসুন, পাশে থাকুন, পাশে রাখুন... এই সুখ স্মৃতিগুলোই আপনার আগামীতে চলার পথের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে থাকবে।

মা বাবা হারিয়ে যে সন্তান নিঃস্ব হয়ে যায়, যে সন্তান অন্যের মাকে দেখেই নিজের মাকে স্মরণ করে, যে সন্তানের দুই হাত খুলে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার একটা মা নেই, যে সন্তানের নিজেকে উজাড় করে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কান্নার সুযোগটুকুও নাই- সেই সন্তানদের পক্ষ হয়েই না হয় বলছি, মাকে পাগলের মত ভালবাসুন, নিজের কাছে রাখুন নয়তো নিজে পাশে থাকুন।

লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন), ডিএমপি