সবুজ বাংলাদেশ গড়তে চান বৃক্ষপ্রেমী আবুল হোসেন

প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:৪৮ | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:৫৭

রানা আহমেদ, সিরাজগঞ্জ

ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কাজের অংশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ, প্রকৃতির সৌন্দর্যবর্ধন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং সবুজ বাংলাদেশ গড়তে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করে নিজ এলাকায় হাজার হাজার সবুজ বৃক্ষ রোপন করে চলেছেন বৃক্ষপ্রেমী আবুল হোসেন।

গত আট বছর ধরে একটি সিরাজগঞ্জ জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ও বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে বৃক্ষরোপন ও একই সাথে শিক্ষার্থীদের বৃক্ষ রোপনে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি নিজের অর্থায়নে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, শহীদ মিনারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১২ হাজার বৃক্ষ রোপন ও চারা বিতরণ করেছেন। দরিদ্র পরিবার চালানোর পাশাপাশি নিজের বেতনের কিছু জমানো টাকায় চলছে তার এই নীরব বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি। পরিবারের নানা অভাব অনটনেও তার এ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি থেমে যায়নি।

বৃক্ষভক্ত এই ব্যক্তি হলেন সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া উপজেলার বড়হর ইউনিয়নের ডেফলবাড়ি গ্রামের ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক আব্দুল কাদেরের ছেলে। তার এই কর্মকা-ের জন্য সকলের সাথে একজন বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ তাকে বৃক্ষ পাগল, বৃক্ষবন্ধু, পরিবেশ যোদ্ধা, সাদা মনের মানুষও বলে ডাকেন। তিনি বৈশ্বিক তাপমাত্রা, কার্বন নিঃসরণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির ক্ষতির ব্যাপকতা রোধ করে আগামী প্রজন্মের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ এবং সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আবুল হোসেন এই বৃক্ষ রোপন বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তার রোপনকৃত এসব গাছের মধ্যে রয়েছে আম, কাঠাল, নারিকেল, লিচু, কাজুবাদাম, জামরুল, চালতা, কদবেল, জলপাই, আমরা, পেয়ারা, বকুল, মেহগনি, দেবদারু ইত্যাদি। একই সাথে সে গ্রামগঞ্জে-পেপে চারা, লাউ, কুমড়া, শসা, করলা, চিচিংগা, ঢেরস, লাল শাক, পুই শাক, মূলা শাক, সবুজ শাক ইত্যাদি সবজি বীজ বিতরণ করেছে। নিজের চাকরির ছুটির দু’দিন সে এই বৃক্ষ রোপন অভিযান কর্মকা- করে থাকে।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকা জানান, আবুল হোসেনের বৃক্ষরোপন, চারা ও সবজি বীজ বিতরণ নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবিদার। তিনি নিজ উদ্যোগে এমন সামাজিক কর্মকা- করায় আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আরশেদ আলী জানান, নিজের সংসারে অভাব থাকা সত্বেও বৃক্ষপ্রেমী আবুল হোসেন প্রতিনিয়ত নিজ অর্থায়নে বৃক্ষ রোপন করে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। ইতিমধ্যে তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচার ক্রেস্ট অব মেরিট ২০১৮ অর্জন করে সিরাজগঞ্জের গৌরব বয়ে এনেছেন। ভবিষ্যতে তিনি তার কাজের জন্য আরো বড় পুরস্কার ছিনিয়ে আনবেন বলে আমি মনে করি। সারাদেশেই আবুল হোসেনের মত স্বেচ্ছাসেবী মানুষ তৈরি হলে বাংলাদেশ হতে পারে সবুজ বিশ্বের রোল মডেল।

ভূমিহীন কৃষক পরিবারে জন্ম হওয়ায় অনেক পরিশ্রম করে লেখাপড়া করতে হয়েছে। বড়হর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জীবনটা একটু ভালো কাটলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয় জীবন শেষ হয়েছে নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়া অবস্থায় ছুটি হলেই স্থানীয় হাট বাজারে বাদাম বিক্রি করতেন।

অনেক প্রতিকূলতা আর সীমাহীন অভাবের শিকারে ২০০০ সালে তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। কারো কোন সহযোগিতা, পড়ালেখা করানোর আশ্বাস না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বিশ টাকা ভাড়া দিয়ে গাড়ির ছাদে বসে ঢাকায় গিয়ে একটি চায়ের দোকানেও কিছু দিন কাজ করেছেন। বাবা-মা ও বড়ভাইয়ের আশ্বাসে আবার ফিরে আসে বাড়িতে। অতঃপর ২০০১ সালে উল্লাপাড়া মার্চেন্ট পাইলট হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে নতুনভাবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন আবুল হোসেন। বড়হর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে। ২০১০ সালে এক্সিম ব্যাংক শিক্ষা বৃত্তি পেয়ে কিছুটা দূর হয় অভাব। হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম শ্রেণি পেয়ে বিবিএস (অনাসর্) সম্পন্ন করে মাস্টার্সে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকেও প্রথম শ্রেণি লাভ করে শেষ করেন শিক্ষাজীবন।

দরিদ্র মা বাবার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, অনেকের সহযোগিতা, নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর অধ্যয়ন আবুল হোসেনকে এনে দিয়েছে ডেফলবাড়ী পূর্বপাড়ার প্রথম মাস্টার্স পাস করার খেতাব। ২০১৩ সালে এক্সিম ব্যাংকে যোগদানের মাধ্যমে শুরু করে পেশাদারি কর্মজীবন। বর্তমানে তিনি এক্সিম ব্যাংক সিরাজগঞ্জ শাখায় কর্মরত আছেন। ছোট বেলা থেকে তার ইচ্ছা ছিল, যদি কখনো নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারেন- তবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কিছু করবেন। সেই তাগাদা থেকে চালিয়েন যাচ্ছে আজীবন মেয়াদী বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি। তার মতে, মানুষের জন্য বিনামূল্যে সবুজ নির্মল পরিবেশ গড়ার চেয়ে বড় কাজ আর নেই।

বৃক্ষ রোপন প্রসঙ্গে আবুল হোসেন জানান, আট বছর ধরে আমি সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে বৃক্ষরোপন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে চারা বিতরণ করে আসছি। এই কার্যক্রম করে আমি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি যা আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। সরকারসহ সকলের সার্বিক সহযোগিতা পেলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে বৃক্ষরোপন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে চারা বিতরণের মাধ্যমে সবুজ শ্যামল ও সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব। বাংলাদেশকে বিশ্বের সবুজ রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এমন কার্যক্রম চালিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। একসাথে ষোল কোটি বৃক্ষরোপন করে বাংলাদেশকে গিনেসরেকর্ড করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জের এই বৃক্ষবন্ধু আবুল হোসেন।

(ঢাকাটাইমস/২৪অক্টোবর/প্রতিনিধি/এলএ)