মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্ট

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৬ অক্টোবর ২০১৮, ২১:১৬

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এবং তার নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে, নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব বাড়বে− এটা স্বাভাবিক। তফসিল ঘোষণা, তারিখ নিয়ে বিতর্ক, প্রযুক্তির ব্যবহার, এসব নিয়ে আলোচনা প্রতিবারই হয়। কিন্তু এবার যেন আলোচনায় নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ। যদিও এরই মধ্যে একজন কমিশনার কবিতা খানম বলেছেন, কমিশনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। উনি বলেছেন বটে, তবে সে কথা কি সবাই বিশ্বাস করেছে? নাকি মানুষের মনে থাকা দ্বিধাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে আরও?

একজন কমিশনার যখন বলেন, আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, তখন অনেকই ভাবতে পারেন, তাহলে হয়তো কিছু আছে। নিশ্চয়ই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন না উঠলে তিনিই বা এ কথা বলতে যাবেন কেন? আর কমিশনারদের একজন যখন তাদের বৈঠক থেকে বের হয়ে দু-দুবার নোট অব ডিসেন্ট দেন, তখন বোঝাই যায়, কিছু একটা ঝামেলা আছে। প্রথমবার নোট অব ডিসেন্ট দিলেন তিনি ইভিএম বিষয়ে, আর অতিসম্প্রতি দ্বিতীয়বার দিলেন সভায় তাকে কথা বলতে না দেয়ার প্রতিবাদে। এত দিন জানতাম, বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত যখন হয়, তখন তাতে কেউ দ্বিমত পোষণ করলে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে থাকেন। কিন্তু কথা বলতে না দেয়ার প্রতিবাদেও যে এই ধরনের আপত্তি করা যায়, সেটা এবারই প্রথম দেখলাম। এদিন কমিশনের সভায় কোনো সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়নি। তাই জনাব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্টটি কোন সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রযোজ্য হবে, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

তবে এ ক্ষেত্রে একটা কৌতূহল কিন্তু থেকেই যায়। সেটি হচ্ছে, মাহবুব তালুকদার আসলে সভায় কী কথা বলতে চেয়েছিলেন? কী কথা বলতে না পেরে উনি ক্ষুব্ধ হলেন? সে বিষয়গুলো তিনি অবশ্য পরে নিজেই পরিষ্কার করেছেন। তিনি জানান, গত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কমিশন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। এতে ৪০টি দল অংশ নেয়। এসব দলের প্রস্তাব ও সুপারিশ নিয়ে এখন পর্যন্ত কমিশনের বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। এ কারণে তিনি তা পর্যালোচনা করে কমিশনের সভায় উত্থাপন করার অনুরোধ জানান। কিন্তু সে আলোচনা না হওয়াতেই ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন যে, তাকে কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না।

এই-ই যদি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু মাহবুব তালুকদারের আবেগকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। প্রস্তাবগুলো নিয়ে কমিশনের অভ্যন্তরে যদি আলোচনা না-ই করবেন, তাহলে তাদের ডেকে নিয়ে এত ঘটা করে মতবিনিময়ের আয়োজনই বা কেন ছিল? এ প্রসঙ্গে সিইসি কিংবা অন্য কমিশনারদের কোনো মতামত জানা যায়নি। দু-একটা মিডিয়া তাদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও তারা কোনো উত্তর দেননি। তবে উত্তর পেলে ভালো হতো, মানুষ একটা সিদ্ধান্ত হয়তো নিতে পারত।

নির্বাচন কমিশনের মধ্যকার এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ কিন্তু একেবারে নতুন কিছু নয়। এই কমিশন গঠনের পর থেকেই এরকম আরও কিছু ঘটনা দেখা গেছে। একবার সিইসি বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে নাÑ এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। এই কথায় বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। তখন নির্বাচন কমিশনের অপর চার কমিশনার বলেছিলেন, সিইসি যা বলেছেন সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত, পুরো নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য নয়। ওই একটি ছাড়া বাকি যে বিরোধগুলো তৈরি হয়েছিল তার প্রায় প্রতিটিতেই বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মাহবুব তালুকদার।

আচ্ছা, মাহবুব তালুকদারের আগে, কোন নির্বাচন কমিশনে, অন্য কোনো কমিশনার কি এভাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন? তাহলে কি আগের কোনো কমিশনের বৈঠকেই নীতি-নৈতিকতার বাইরে যায়−এমন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি? নাকি আগের কমিশনগুলোতে তার মতো নীতিবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর কেউই ছিলেন না? মাহবুব তালুকদার− এই নামটির সঙ্গে আমি অনেক আগে থেকেই পরিচিত। সরকারের আমলা ছিলেন। ওনার অনেক স্মৃতিচারণামূলক লেখা পড়েছি। গল্পও উনি মন্দ লেখেন না। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর অনেকদিন ধরেই অবসর জীবন যাপন করছিলেন। তারপর, আমাদের দেশের যা রীতি− অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ধরে ধরে এনে বিভিন্ন কমিশনে বসিয়ে দেয়া, ওনাকেও তাই করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগের জীবন এবং কর্মকা-ে এই ভদ্রলোককে কখনো খুব একটা বিপ্লবী টাইপ মনে হয়নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে তার কর্মকা-ে অন্তত দুবার তিনি বেশ প্রথাবিরুদ্ধ আচরণই করলেন।

আগে কখনো ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়নি বলে যে শেষ বেলায় হবেই না− এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তাছাড়া আগে তিনি সরকারের চাকুরে ছিলেন, সেখানে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সুযোগটাই বা কোথায়। আর এখন রয়েছেন একটা সাংবিধানিক পদে। এ পদের মর্যাদা যেমন বেশি, তেমন বেশি দায়িত্বও। এটি একটি নির্দলীয় পদ। এই পদে আসীন ব্যক্তি কোনো দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে না− এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এই প্রত্যাশা বিগত বছরগুলোতে তেমন একটা পূরণ হয়েছে বলে মনে হয় না। এভাবে ভাবতে গেলে অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন যে, তাহলে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে তো তিনি দুর্দান্ত একটা প্রতিবাদই করেছেন। তবে পাশাপাশি এ কথাও বিবেচনায় রাখা দরকার, প্রতিবাদ মানেই সব সময় নিরপেক্ষতা নয়। এটা অনেক সময় বিরোধীপক্ষের অনুকূলেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই প্রত্যাশিত নিরপেক্ষতাই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ আশঙ্কাটি আরও দৃঢ় ভিত্তি পায়, যখন দেখা যায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রকাশ্যে মাহবুব তালুকদারের পক্ষ নেয়, সিইসির পদত্যাগ দাবি করে।

নোট অব ডিসেন্টের পাশাপাশি সভা থেকে বের হয়ে দুবারই, কেন তিনি কী করেছেন− সে বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন মিডিয়ার সঙ্গে। ফলে দ্রুতই তার মতামত পৌঁছে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে। এসব ঘটনার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে যে মেসেজটি গেছে তা হলো− নির্বাচন কমিশনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ আছে। জাতীয় নির্বাচন এখন জাতির দরজায় কড়া নাড়ছে, এমন সময়ে কমিশনের অভ্যন্তরে এরকম বিরোধের সংবাদ মোটেই সুখকর নয়। বরং উল্টো, এরকম সংবাদ সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বিধার জন্ম দেয়। এরা একটি বিশাল নির্বাচনযজ্ঞ যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় তৈরি হয়। এমন সংশয় প্রত্যাশিত নয়।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :