‘উদ্ধত’ জামায়াত এখন ‘সন্ত্রস্ত’

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০১৮, ১০:৩৫

রেজা করিম

‘জামায়াত কখনো নিশ্চুপ থাকেনি, থাকবেও না। নিশ্চুপ থাকলে ইমান থাকবে না’-এ মন্তব্য জামায়াতের দায়িত্বশীল এক নেতার।

নিজেদের ‘ইমানি দায়িত্ব পালনের সেনা’ দাবি করে ঢাকা টাইমসের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি। যদিও তার আত্মবিশ্বাসী এ বচনের বিপরীতে দলটির বর্তমান কর্মকাণ্ডের বিস্তর ফারাক।

রাজধানীর মগবাজারে দলটির কেন্দ্রীয় দপ্তর এবং পুরানা পল্টনে মহানগর কার্যালয়ের সদর দরজা পর্যন্ত গেলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে তাদের ‘ইমানি শক্তির’ চেহারা।

প্রধান দুটি কার্যালয়ের মতো সারাদেশে দলটির প্রায় সব কার্যালয়েই তালা ঝুলছে দলের শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই। কবে খুলবে বা খোলা হতে পারে জানা নেই কারও।

দলটির সব ধরনের কার্যক্রম চলছে অত্যন্ত গোপনে ও সাবধানে। সংবাদ সম্মেলনও করা হয় মূলধারার গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের না জানিয়ে, কেবল নিজ ঘরানাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে। পরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দেয়া হয় বার্তা।

পর্দার আড়ালে থেকে রাজনীতি করায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছে দলটি। এ ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচারের কৌশল অবশ্য এখন আর আগের মতো কাজে দিচ্ছে না। সেই সঙ্গে এর পেছনে থাকা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারও একটি কারণ।

২০১০ সালের ২৯ জুন দলের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গ্রেপ্তারের পর ভীতি ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল জামায়াত। রাজনীতিতে প্রচার পায়, তারা রাজপথ দখলে নিয়ে ব্যাপক হাঙ্গামা করবে। পরে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দলের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দ- আসার পর নজিরবিহীন সহিংসতাও করে তারা। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের আগের রাতে মোবাইল ফোনে গৃহযুদ্ধ শুরুর হুমকিও দেয় দলটি। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকে তারা।

যদিও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো এবং ২০১৫ সালে সরকার পতনের আন্দোলনের সময়ও সহিংসতার জন্যও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদেরই দায়ী করা হয়। আর দুই দফা আন্দোলনে ব্যর্থতার পর থেকে দলটির উচ্চবাচ্য ছাড়া আর কোনো কর্মসূচি নেই।

মাঠে এখন সক্রিয় হয় জামায়াত, নানা সময় কাগুজে কর্মসূচি দিয়ে চুপ থেকেছে। মাঝে মাঝে নেতাকর্মীরা গুপ্ত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কাছে হার মেনে শেষমেশ অনেকটাই গোপন রাজনীতিতে নামতে বাধ্য হয়েছেন নেতাকর্মীরা।

জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনগুলোও চলে গেছে আড়ালে। এভাবে এক সময়কার ‘দাম্ভিক’ দলটিকে ঘিরে এখন আর আগের মতো আলোচনাই হয় না। বিশেষ করে বিএনপি ২০ দলকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গঠন করার পর থেকে জামায়াতকে বিএনপিও আর খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না।

রাজধানীর মগবাজার ওয়্যারলেস রেলগেট সংলগ্ন জামায়াতের কেন্দ্রীয় দপ্তরে গিয়ে তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায় প্রধান ফটক। বড় মগবাজারের ব্যাপারী লেনের ৫০৫ নম্বর বাড়িটির ভবনের দেয়ালে ধুলো ময়লার আস্তরণ জমেছে।

তবে ভেতরে লোক ছিলেন। ফটকে টোকা দেয়ার অনেকটা সময় পরে দরজা খুলে দিলেন একজন নিরাপত্তারক্ষী। আবুল কালাম আজাদ নামের ওই নিরাপত্তারক্ষী ঢাকা টাইমসকে জানান, তারা সাতজন কার্যালয়টির দেখভাল করছেন। এখানে ভয়ে দলের নেতাকর্মীরা কেউ না এলেও মাঝে মাঝেই গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এসে ঢুঁ মেরে যায়।

আজাদ বলেন, ‘মাঝে মাঝে বেতন পেতে দেরি হয়।’ যদিও দলটির প্রতি নিষ্ঠা থাকায় এ নিয়ে তাদের মনে কোনো খেদ নেই বলেও জানান এই নিরাপত্তাকর্মী।
পুরানা পল্টনের দলটির ঢাকা মহানগর কার্যালয়টির প্রধান দরজাই আর নেই। পাশেই নতুন একটি ভবন নির্মিত হওয়ায় কার্যালয়টি আড়ালে পড়ে গেছে। প্রধান কার্যালয়ের মতো এখানেও নেতাকর্মীরা আসেন না।

যদিও কার্যালয়ে আসতে না পারলেও পারস্পরিক যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। আর মোবাইল ফোনে আড়িপাতার সমস্যা এড়াতে ইন্টারনেটভিত্তিক বার্তা আদান-প্রদান চলছে।

বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত পৌঁছে দিতে জন্য দলটির প্রচারণা বিভাগ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকে। আর এসব কাজও করা হচ্ছে অতি গোপনে ও সাবধানে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ ও নায়েবে আমির শামসুল ইসলাম ছাড়া দলের শীর্ষ নেতাদের আর কেউ কারাবন্দি নেই এ মুহূর্তে। দলের আমির মকবুল আহমাদ, সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান মুক্ত থাকলেও উধাও হয়ে আছেন।

প্রায় সময়ই নেতাদের ফোন সচল থাকে না। ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে উপস্থিত দলের প্রতিনিধি আবদুল হালিম এক ব্যাগ মোবাইল নিয়ে ঘুরেন। একদিন নম্বর চাইলে ১৩টি নম্বর দেন তিনি। যদিও এই নম্বরগুলোও সচল থাকে না সব সময়। বিশেষ করে অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসলে তা সাধারণত ধরেন না।
এভাবে একেক নেতার ১০ থেকে ১২টা পর্যন্ত সিমকার্ড রয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার ২০টির মত সিম কার্ড থাকার খবর জানা গেছে।

কোনো কোনো নেতা সকালে এক নম্বর ব্যবহার করলে দুপুরে আর তাকে সে নম্বরে পাওয়া যায় না। আবার সন্ধ্যা বা রাতেও পরিবর্তন করছেন নম্বর।
দলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের প্রায় সব কার্যালয়ই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে কাজ করার তো সুযোগই দিচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ নেই। এর মধ্যে যতটুকু করা যায়, তাই করা হচ্ছে।’

দলের আরও একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের, যারা গণমাধ্যমের কাছে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতেও রাজি নন। তাদেরই একজন বলেন, ‘জামায়াতের রাজনীতি আর দশটা দলের মতো নয়। দলটি দ্বীনের পথে কল্যাণের জন্য কাজ করে। আর দ্বীনের পথে চুপি চুপি কাজ করা যায় না। নিশ্চুপ থাকলে ইমান থাকে না। এ জন্য জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকা- অব্যাহত রয়েছে। যথারীতি দাওয়াত, নেতাকর্মীদের সংগঠিতকরণ, প্রশিক্ষণ দান ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

‘সময়টা খারাপ যাচ্ছে’- এমন মন্তব্য করে আরেকজন নেতা বলেন, ‘চাইলেও বর্তমানে প্রকাশ্যে জামায়াত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। যে কারণে বাধ্য হয়েই গোপনে সাংগঠনিক কর্মকা- চলছে। তবে ইমানি শক্তির বলে প্রতিকূলতার মধ্যেও সে কাজগুলো সম্পন্ন হচ্ছে।’