হিজড়াদের নিয়ে মেহেদী ও সেলফি উৎসব
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা হিজড়ারা সমাজে অবহেলিত। সমাজে তাদের অবস্থা বরাবরই ভিন্ন। তৃতীয় লিঙ্গের এই জাতিকে ঘিরে বিশ্বের ভিন্ন দেশের নানা পদক্ষেপ থাকলেও বাংলাদেশে এখনো এদের অবস্থান সুদৃঢ় নয়। অবহেলিত এ গোষ্ঠীর মানুষদের ঠিকানা হয় সর্দার বা দলনেতার কাছে। এরাই সাধারণ হিজড়াদের কাজে লাগিয়ে টাকা উত্তোলন করান বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে। বিনিময়ে সাধারণ হিজড়ারা পেয়ে থাকেন মূল আয়ের একটা অংশ।
বিভিন্ন সময়ে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক সিগনাল পয়েন্টে দেখ মেলে হিজড়াদের। দেখা যায় সিগনালে থেমে থাকা গাড়ি থেকে টাকা তুলতে। এছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হিজড়াদের আনাগোনার বিষয়ে সকলেই অবগত। কিন্তু দায় ঠেকেই এই পথ বেছে নিতে হয় এই জাতি স্বত্বাকে।
ধানমন্ডির রবিন্দ্র সরোবরে নিয়মিত দেখা মেলে এ্যাঞ্জেলের। তৃতীয় লিঙ্গের এ্যাঞ্জেল পরিবার থেকে বিতারিত। এখন পরিবার বলতে সর্দার। সর্দারের আওতাভুক্ত হয়ে কাজ করেন এমন অনেক হিজড়া। বিনিময় হিসেবে পান মূল আয়ের ত্রিশ শতাংশ।
ঢাকাটাইমসের সাথে আলাপকালে এ্যাঞ্জেল জানান, ‘আমি এই অবস্থায় থাকতে চাই না। কেউ চায় না। আমাদের একটা সুন্দর জীবন দরকার। একটা পরিচয় দরকার।’
ধীরে ধীরে সে ‘পরিচয়’ মিলতে যাচ্ছে হিজড়াদের। তৃতীয় লিঙ্গের জাতি হিসেবে স্বীকৃতির সিদ্ধান্তের দিবসে রাজধানীর ছয়টি স্থানে হিজড়াদের নিয়ে 'খোলা হাওয়া' নামে মেহেদি ও সেলফি উৎসব করা হয়েছে।
গবেষণা ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান 'রি-থিংক' এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আয়োজিত এই উৎসবে হিজড়ারা সবলিঙ্গের মানুষদের মেহেদি পরিয়ে দেন। মেহেদি পরানোর পাশাপাশি সবাই মেতে ওঠেন সেলফি উৎসবে ।
রবিবার সকাল ১০ টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত স্বোপার্জিত স্বাধীনতা সড়ক, দুর্ঘটনা স্মৃতি স্থাপনা, ছবির হাট, সমাজ কল্যাণ অনুষদ চত্ত্বর ও ইডেন মহিলা কলেজ ফুটপাতে মেহেদি ও সেলফি উৎসব হয়। এছাড়া বেলা সাড়ে ১২ টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত মেহেদি ও সেলফি উৎসব হয় বুয়েটে।
এ সময় নারীদের হাতে মেহেদী পরিয়ে দেন হিজড়ারা। চলে সেলফি তোলার উৎসব। উৎসবে যোগ দেন লিজা। তিতুমির কলেজের স্নাতক বিভাগের এ ছাত্রী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হিজড়ারা মানুষ। তারা আমাদেরই মত। আমাদের সাথে তাদের যে অমিল, সেটাকে বড় করে দেখাটা কখনোই উচিত না। এই ধরনের আয়োজন আরো করা উচিত। এতে করে এ সমাজের মধ্যেও একটা আমূল পরিবর্তন সম্ভব।’
লিজা নিজে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি আগে থেকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার বন্ধু ও পরিচিতজনদের। লিজার মত অনেকেই যোগ দিয়েছেন এই মেহেদী ও সেলফি উৎসবে।
২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে এই জনগোষ্ঠীকে আলাদা 'লিঙ্গ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গ্রহণ করা হয়, হিজড়া জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম নীতিমালা-২০১৩। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে তাদের 'হিজড়া লিঙ্গ' হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১৮ জানুয়ারিতে সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় ভোটার তালিকায় 'নারী' ও 'পুরুষে'র পাশাপাশি 'হিজড়া' একটি আলাদা লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে স্থান পাবে।
'হিজড়া লিঙ্গ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্তের দিনে (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে রি-থিংক। মেহেদি ও সেলফি উৎসব ছাড়াও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিন্দুধারী'তে রি-থিংক' এর আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হিজড়ারা প্রদর্শন করেন নাচ, গান, আবৃতি ও অভিনয়।
আয়োজক সংস্থা জানায়, পরিবার, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র ও বৃহত্তর সমাজের সবখানেই চরম ভাবে অবহেলিত হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে সংগীত পরিবেশন করেন কন্ঠশিল্পী রফিকুল আলম, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী আবু বক্কর সিদ্দিক ও চন্দনা মজুমদার।
ঢাকাটাইমস/১১নভেম্বর/কেআর/ ইএস