মাশরাফি জিতে গেলে জিতে যাবে বাংলাদেশ

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৫৪ | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:৪৮

শেখ আদনান ফাহাদ

বাংলাদেশের প্রাণ মাশরাফি বিন মুর্তজা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রিয় মানুষ নড়াইলের ছেলে মাশরাফি যাকে এলাকার লোক জানে তাদের আদরের ‘কৌশিক’ হিসেবে। ইনজুরির নানা আঘাত নিয়েও অদম্য সাহস আর বীরত্বে অসাধারণ ক্রিকেট খেলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মাথা উঁচু করা মাশরাফি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় একাদশতম সংসদ নির্বাচনে লড়তে নমিনেশন ফরম কিনেছেন। একাদশতম নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চমক হয়ে লেখা থাকবে মাশরাফির নির্বাচনের কথা।

দুই ধরনের মানুষ মাশরাফির রাজনীতিতে আসার বিরোধিতা করছে। প্রথমত, যারা রাজনীতিকে ‘ঘৃণা’ করে। এই অংশটির বর্ণনা দেয়া সহজ নয়। এরা ফেসবুকে লিখে রাখে ‘আই হেইট পলিটিক্স’। এরা মনে করে, রাজনীতিবিদ মানেই দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ। ‘রাজনীতি’ কী, না বুঝে, না জেনে রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে দেশের মেধাবী, সৎ প্রজন্ম। অথচ রাজনীতিবিদরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনকে পরাভূত করেছেন।

রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা, রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তবে নতুন প্রজন্ম দেখছে, স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতিপ্রিয়, কপট ও বিশ্বাসঘাতক। এদের জন্যই রাজনীতি কে ঘৃণা করা দেশের ছেলে-মেয়েদের একটা বিরাট অংশ। সংগত কারণে মাশরাফি বিন মুর্তজার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত তরুণ সমাজের একটা অংশ। তবে মাশরাফির যেকোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে এরা আছেন। এরা মন থেকে মাশরাফিকে ভালোবাসেন।

দ্বিতীয়ত, আরেক দল মানুষ যারা খুবই দূরদর্শী এবং পরিণামদর্শী। এরা জানে মাশরাফি যদি সফল হয়ে যান, তাহলে বাংলাদেশ সফল হয়ে যাবে। এরা মাশরাফিকে থামাতে চায়, কারণ এরা বাংলাদেশের অগ্রগতিতে শঙ্কিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গুণে, সাফল্যে চরম ঈর্ষান্বিত। এরা নানা কারণ দেখিয়ে, কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে মাশরাফির বিরোধিতা করছে। এরা শুধু বিরোধিতা করছে তা নয়, ফেসবুক, ইউটিউবে মাশরাফির মতো আন্তর্জাতিক আইকনের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ভাষায় অপপ্রচার চালাচ্ছে। মাশরাফি নির্বাচনে আসুক বা জিতুক এরা কোনোভাবেই চাচ্ছে না। এরা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর উত্তরাধিকারী।

খুব কৌশলের সাথে মাশরাফির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে দেশে। অপপ্রচারের মিশনে নেমেছে কিছু শীর্ষ সংবাদমাধ্যমও। শেখ হাসিনাকে যে কোনো মূল্যে ব্যর্থ দেখতে চায় এই মহল। সোনার বাংলা নির্মাণের সংগ্রামে শেখ হাসিনার সাথে মাশরাফি যোগ দেয়ায় রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
সংসদ নির্বাচন একটি জাতীয় মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের সরকার, বিরোধী দল, সংসদ, সংবিধান, আইন-কানুন ইত্যাদি বিষয়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে একটি সংসদ নির্বাচন। সংসদে সৎ, মেধাবী, পরিশ্রমী, দেশপ্রেমিক মানুষ গেলে দেশ ও জাতির মঙ্গল। আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সব বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করা হয়। মাশরাফি এমন এক সময় আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন ফরম নিয়েছেন যখন দেশ ও জাতি সমৃদ্ধির মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে। খেলোয়াড় মাশরাফি জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য ও অধিনায়ক হিসেবে অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন। রাজনীতির প্রক্রিয়ায় একজন নেতাকে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয়। বলাবাহুল্য মাশরাফি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন।

‘ক্রিকেটে আরও অনেক কিছু দেয়ার আছে মাশরাফির’ কিংবা ‘খেলা ছেড়ে দেবেন মাশরাফি’?, এ জাতীয় নানা শিরোনাম করে সংবাদ প্রচার করছে কিছু গণমাধ্যম। এভাবে সংবাদ প্রচার করার উদ্দেশ্য মাশরাফিকে ক্রিকেটে ধরে রাখার জন্য না। মাশরাফিকে কৌশলে থামিয়ে দেয়ার জন্য এই প্রচার। পুরো দেশে, বিশেষ করে নড়াইলের মানুষের ভেতরে একটা সংশয়, সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চায় অপপ্রচারকারীরা। মাশরাফির ভেতরেও একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করতে চায় বিরোধী শিবির। ফেসবুকে, ইউটিউবে খুব আবেগঘন কথাবার্তা বলে চলেছেন ভক্ত বলে পরিচয় দেয়া কিছু মানুষ।

মাশরাফি যদি বিএনপি বা জামায়াতে যোগ দিতেন তাহলে বোধহয় তাদের দুঃখ থাকত না। জাতীয় বীর মাশরাফি শেখ হাসিনাকে তার নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এটাই সহ্য হচ্ছে না পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের। মাশরাফির মতো একজন দেশপ্রেমিক, সাহসী মানুষ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলেই যোগ দেবেন, শেখ হাসিনার মতো বিশ্বনেতার নেতৃত্বে মুগ্ধ হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। মাশরাফির আগে বহু জাতীয় তারকা আওয়ামী লীগের আদর্শে মুগ্ধ হয়েছেন।

এক সময়ের মহাতারকা, ফুটবলার কাজী সালাউদ্দীন আজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে কাজ করে গেছেন। যে কোনো খেলোয়াড় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মুগ্ধ হবেন এটা স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু নিজে জাতীয় ক্লাব পর্যায়ে ফুটবল খেলতেন, তার ছেলে শেখ কামাল আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। শেখ কামাল নিজেও একজন ভালো পেসবোলার ছিলেন। কাজী সালাউদ্দীন ছিলেন শেখ কামালের বন্ধু।

বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুর রহমান বাবুর একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘জাতীয় ফুটবলের মহাতারকা বাদল রায়, শফিউল আরেফিন টুটুল এবং গোলাম সারওয়ার টিপু, আশরাফ উদ্দীন চুন্নু, বিভিন্ন সময় নৌকা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন। মোহামেডানের বাদল রায় নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে, ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক হয়েও মোহামেডানেরই থেকে গেছেন। লাখ লাখ মোহামেডান অন্তঃপ্রাণ সমর্থকদের মনের গহীনে বাদল রায়, বাদল দাই আছেন, আওয়ামী লীগার বনে যাননি। টুটুল ভাই আর চুন্নু ভাইও তাই। একইভাবে ৮০র লিগ বিজয়ী মোহামেডানের গোলরক্ষক ওয়াহিদুজ্জামান পিন্টু (সম্ভবত জাসদ ছাত্রলীগ থেকে), দক্ষ রাইটউইং ব্যাক ও বর্তমান নামি প্রশিক্ষক শফিকুল ইসলাম মানিক ভাই ছাত্রলীগ থেকে এবং জনি ভাই ছাত্রলীগ থেকে ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচন করে বিজয়ী দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ আর সেরা লেফট ব্যাক ইমতিয়াজ সুলতান জনি ভাইও যথাক্রমে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ মুজিববাদী এবং থেকে ডাকসুতে ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছেন আর নামি গোলরক্ষক সাইদ হাসান কানন ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচনে জাতীয়বাদী ছাত্রদলের প্যানেল থেকে নির্বাচন করে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।’

বিএনপির বড় নেতা মেজর অব. হাফিজ একসময় ছিলেন দেশসেরা স্ট্রাইকার। দেশের ইতিহাসের আরেক সফল ফুটবলার সালাম মোর্শেদী সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ব্যানারে উপনির্বাচনে এমপি হয়েছেন। নতুন প্রজন্ম এ তথ্যগুলো জানে না বলেই হয়ত মাশরাফির নমিনশেন চাওয়া নিয়ে অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে। লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট একজন বিশ্বসেরা ফুটবলার ছিলেন। ভারতের বহু ক্রিকেটার খেলা ছেড়ে এমপি হয়েছেন। বহু বলিউড তারকা রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন।

সত্য হলো, মাশরাফি আজীবন ক্রিকেট খেলবেন না। একদিন না একদিন তাকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে হবে। মাশরাফি তো এর আগে বহুবারই অবসর বাস্তবতা মোকাবেলা করেছেন। এত ইনজুরি নিয়ে বিশ্বের আর কোনো ক্রিকেটার বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এত ক্রিকেট খেলে বলে জানা নেই। মাশরাফি লড়াকু ক্রিকেট খেলছেন, সফল অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি আজ আমাদের খুব প্রিয় মানুষ। এই মাশরাফিই যখন বোলিংয়ে ব্যর্থ হবেন, অধিনায়ক হিসেবে ব্যর্থ হবেন তখন আমাদের আজকের এই ভালোবাসা অটুট থাকবে কি? মাশরাফি কখন ক্রিকেট খেলবেন, কখন অবসরে যাবেন এ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সম্পূর্ণ মাশরাফির।

পৃথিবীর প্রায় সব বুদ্ধিমান খেলোয়াড় নিজেদের ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় অবসরে যান। অবসরে যাবেন কি না, মাশরাফি এমন কোনো ঘোষণা এখনো দেননি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এমপি হয়ে যাবার পর মাশরাফির জন্য ক্রিকেট খেলা সহজ হবে না। একজন এমপির জীবন আর মাশরাফির মতো ক্রিকেটারের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এমপি হয়ে গেলে মাশরাফি অন্য কোনো ভূমিকায় শুধু ক্রিকেট নয়, দেশের পুরো ক্রীড়া জগতকে বদলে দেয়ার পেছনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে পারেন। নড়াইলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পেছনে ভূমিকা তো রাখবেনই। একজন এমপি যদি সৎ ও আন্তরিক হোন, এলাকার উন্নয়ন হবেই। মাশরাফি শুধু নড়াইলের তার সেই সংসদীয় আসন নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন না। মাশরাফির মতো ব্যক্তিত্বকে জাতীয় পর্যায়ে কাজে লাগাতে হবে। মাশরাফিকে বিসিবি প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব দেয়া যাবে। মাশরাফিকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পজিশনেও দেখা যেতে পারে। আর পুরো দেশের শিশু-কিশোরদের কোনো বিশেষ প্রকল্পের আওতায় সোনার বাংলা নির্মাণে উদ্দীপিত করতে মাশরাফির চেয়ে বড় আইকন কে হতে পারবে?    

মাশরাফির নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত তাই সময়োপযোগী। মাশরাফিকে সমর্থন দেয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। মাশরাফির মন খারাপ হয়, মাশরাফির মনে দ্বিধা আসতে পারে এমন সব প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সোনার বাংলা নির্মাণে মাশরাফির সিদ্ধান্তকে আমরা সফল করব, এটাই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়