ধানের শীষ নিয়ে জিততে পারবেন মান্না?

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ২১:৫৫

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
মাহমুদুর রহমান মান্নার সাথে লেথক

মাহমুদুর রহমান মান্না স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেনl নিজস্ব জনপ্রিয়তায় ছাত্র সংসদে ভিপি নির্বাচনে বার বার জয়ী হয়েছেনl পরে জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ওই সময় ছাত্র রাজনীতির মাঠ মানেই মাহমুদুর রহমান মান্না। পরে একসময় এই ছাত্র নেতার পথচলা শুরু হয় জাতীয় রাজনীতিতে। যে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগে ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সূর্যের আশা নামে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে জড়িত ছিলেনl

মান্নার সঙ্গে আমার সাক্ষাতটা ছিল একটু ভিন্ন। সময়টা ১৯৭৪ সাল। আমি তখন ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক। আর তিনি ছিলেন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা আইডিয়াল কলেজ জাসদ ছাত্রলীগের এক কর্মিসভায় তিনি প্রধান অতিথি। জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কলেজ শাখার নেতা জাহিদ মান্না ভাইয়ের সভায় যেন কোনো গোলমাল না হয়, এ ব্যাপারে আমাকে অনুরোধ করেন।কারণ, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আইডিয়াল কলেজের নেতা মান্নার কলেজ প্রাঙ্গনে প্রবেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। 

এ ধরণের একটা পরিস্থিতিতে কী করব আর কী করব না, তা ঠিক করে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে সভা করার অধিকার তো তার আছে। কিন্তু কীভাবে উত্তেজিত ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা করে জাহিদকে ডেকে বললাম, ‘তোমাদের নেতা এখানে সভা করতে পারবে। কোনো রকম গণ্ডগোল হবে না। তবে শর্ত একটাই, তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো অশালীন বক্তব্য বা কটূ কথা বলতে পারবেন না। যদি বলেন তাহলে আমার পক্ষে উত্তেজিত ছাত্রদের দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে না’।সে আমার কোথায় রাজি হলো।

ওই সময় ছাত্রলীগ (আ স রব-শাহজাহান সিরাজ) নেতারা তাদের বক্তব্যের কোথায় কোথায় সব সময় বঙ্গবন্ধুকে গালি গালাজ ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে বক্তব্য রাখতেন। আমি  নিশ্চিত ছিলাম তিনি (মান্না) তার ব্যতিক্রম হবেন না। বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি এক সময় করলেনও তাই। সেইসাথে সভা হলো পণ্ড। ওনাকে কলেজ ছাত্রলীগের উত্তেজিত নেতা কর্মীরা কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেয়। এই সময় আমি কলেজের আম্রকাননের নিচে বসেছিলাম। কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বারবার আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমাকে অবশ্য তার চেনার কোনো কথা নয়।

বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বিরোধী মাহমুদুর রহমান মান্না পরবর্তীতে বাসদ ও বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়কl তবে আশ্চর্য  হলেও  সত্য যে, এক সময়ের কট্টর বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক নেতা বাইকে অবাক করে শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি প্রথমবার জনতা মুক্তি পার্টি ও দুইবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে বগুড়া থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। 

শুনেছি বার বার বগুড়ায় পরাজিত হয়ে তিনি শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেছিলেন তাকে ঢাকা থেকে নমিনেশন দেওয়ার জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনা তা না দেওয়ায় তিনি অসন্তুষ্ট হন। এখানেই শেষ নয়, তার শেষ আবদার ছিল ঢাকা থেকে মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন। সেই আবদার থেকেও বঞ্চিত হন। তবে শেখ হাসিনা তার অতীত কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আওয়ামী লীগের মতো বিশাল সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাগঠনিক সম্পাদক করেছিলেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য  যে  ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনার সভায় তিনিও (মান্না) উপস্থিত ছিলেন এবং এইসময়  তার  চোখে স্প্লিন্টার লাগায় এখনো  তিনি  নিয়মিত ল্যান্স ব্যবহার করেন।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালীন মান্নার সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ হয়। বিএনপি জামায়াত জোট সরকার তখন ক্ষমতায়। এই সময় তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমার নেওয়া সেই সাক্ষাৎকার থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:

একসময়ে আপনি আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অথচ এখন আপনি আওয়ামী লীগের কণ্ঠস্বরl আপনি আওয়ামী লীগে কেন এলেন?

মান্না: আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম। ৮০ দশকের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে ঢালাও পরিবর্তন নিয়ে আসে, তাতে প্রমাণিত হয় যে সমাজতন্ত্র আর সম্ভব নয়। সমাজতন্ত্র আর চলবে না। আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রিক দল নয়। তবে সমাজতন্ত্রের যে ধ্যান ধারণা আছে তা কিছুটা হলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ হলো একটি রাজনৈতিক দল যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। সব কিছু ভেবে চিন্তে আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করেছি।

আপনার এলাকায়(বগুড়া) বিএনপির বার বার জয়ের কারণ কি ?

মান্না: এলাকাটা আসলে মুসলিম লীগের একটি শক্ত এলাকা। যারা একসময় মুসলিম লীগ করতো তারাই পরবর্তীতে এখানে বিএনপির রাজনীতিতে চলে আসে। পরে এদের সাথে এসে জোট বাঁধে জামায়াত। জামায়াত ও বিএনপির যৌথশক্তি একত্রিত হওয়ায় এলাকাটা বিএনপির একটি ঘাঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপি জামায়াত জোট সরকার কর্তৃক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থানের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

মান্না: মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়l এটা এক ধরনের প্রতিশোধ পরায়ণতা।

গত নির্বাচনে (২০০১) আওয়ামী লীগের পরাজয়ের প্রধান কারণ আপনি কী বলে মনে করেন?

মান্না: এটা একটা বিরাট পরিকল্পনা ছিল। এখানে একটা নীলনকশা এবং দেশি বিদেশি শক্তিগুলো জড়িত ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের এই নীল নকশার ফসল। আমাদের পরাজয় হয়েছে এই এই পরিকল্পিত নীল নকশার কাছে।

এই সময় আমার সাথে তিনি জাতির জনক  বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ এবং  মুক্তিযুদ্ধের  শক্তির পক্ষে আরো  অনেক কথা বলেন। সেদিন তার বক্তব্যে আমি ধারণা করেছিলাম, খুব শিগ্রই তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার খুব কাছাকাছি আসার সুযোগ করে নিতে পারবেন।

কিন্তু আমার ধারণা হলো সম্পূর্ণ উল্টো। আবারো তিনি জাতীয় রাজনীতিতে দিলেন ডিগবাজি। আর এবার হাতে নিলেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ধানের শীষ প্রতীক।

এখন আসছে নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সম্ভবত বগুড়ার আসন থেকে নির্বাচন করবেন মান্নাl  এই  নির্বাচন এলাকাটা বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।আগামী নির্বাচনে বিএনপি–জামায়াতের সমর্থন কাজে লাগিয়ে হয়তবা এই যাত্রায় তার জয়ী হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।তবে শোনা যাচ্ছে এই আসনে বিএনপির শরিক দল জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার ইচ্ছা আছে। যেখানে ধানের শীষ নিয়ে তার (মান্না) এগিয়ে থাকার কথা, সেখানে জামায়াত প্রার্থী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ফলে জামায়াত আর মান্নার দ্বন্দ্বে মাঝখান থেকে এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ধানের শীষের প্রতি তার ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে তিনি ইদানী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে চলছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস আসছে নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে বসার সুযোগ পাবেন।বার বার রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পারবেন কি মাহমুদুর রহমান মান্না জয়ী হতে?

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক