মায়ের কোল কি ফিরে পাবে নবজাতক ফাতেমা?

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৮, ২১:১২

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

‘মাত্র নয় দিন বয়সেই মায়ের কোল থেকে বিক্রি হওয়া শিশু ফাতেমা কি মায়ের কোল ফিরে পাবে? নিজের মাকে মা বলে ডাকতে পারবে? ভাই-বোনের সাথে বড় হতে পারবে? কি অপরাধ করেছিল শিশু ফাতেমা’- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।

বলছিলাম কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি পাইকপাড়া এলাকায় জন্মের নয় দিনের মাথায় কন্যা শিশু বিক্রি করে দেয়ার মতো লোমহর্ষক সেই ঘটনার কথা। পরপর তিন কন্যা সন্তানকে জন্ম দেয়ায় স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মাত্র নয় দিনের কন্যা শিশুকে বিক্রি করেন রবিউল ইসলাম।

দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের হযরত আলীর ছেলে রবিউল ইসলাম একই এলাকার রেজাউল হকের মেয়ে জেসমিনের সাথে গত ১০ বছর আগে বিয়ে হয়। এর আগে জেসমিনের আরেক স্থানে বিয়ে হয়। বিয়ের দুই মাসের মাথায় রবিউল ইসলামের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন জেসমিন। তারপর দুজনে পালিয়ে বিয়ে করেন। বাঁধেন সুখের সংসার। তাদের ঘর আলোকিত করে আসে সালেকী নামে এক মেয়ে। তারপর কয়েক বছর পরে আবারো মায়া নামে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন জেসমিন। পরপর দুই কন্যা সন্তান হওয়ায় তার উপরে নেমে আসে নির্যাতন। চলতি বছরেই জেসমিনের গর্ভে আসে আরো একটি সন্তান। এই নিয়ে স্বামীর সাথে শুরু হয় মনমানিল্য। রবিউল দাবি করেন, জেসমিনের গর্ভের তৃতীয় সন্তান তার নয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একাধিকবার বাবার বাড়িতে চলে আসেন জেসমিন। এর মধ্যে পাশের এলাকার এক গৃহবধূর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন রবিউল। বিয়ে করে ঘরে তুলে আনেন। আবারো বাঁধে পারিবারিক অশান্তি। এরই মাঝে ৭ নভেম্বর আরেকটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন জেসমিন। এই নিয়ে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্য দেন তিনি।

এই অপরাধে নয় দিনের শিশুসহ তাকে তালাক দেন রবিউল।

১৬ নভেম্বর স্থানীয় ইউপি সদস্য শরিফুল, মাতব্বর শহিদুল ইসলাম এবং খলিসাকুণ্ডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান আসলামের সহযোগিতায় শালিশি বৈঠক করেন রবিউল। সেখানে তার সদ্য সন্তান প্রসব করা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন।

তবে স্ত্রীকে তালাক দিতে তার দেনমোহরের টাকা দিতে হবে। রবিউল পেশায় একজন কৃষক। টাকা কোথায় পাবেন। তাই মা জেসমিনের কোল থেকে শিশু কন্যাকে মাতব্বর শহিদুল ইসলামের সহায়তায় কেড়ে নেন রবিউল। শিশুটিকে বিক্রি করে দেয়া হয় ঈদগাহপাড়ার আয়ূব আলীর কাছে। শিশুটিকে হারিয়ে ভেঙে পড়েন জেসমিন।

জেসমিন জানান, ‘আমার স্বামী জোর করে কোল থেকে আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিয়েছে। শুনেছি, তারা শিশুকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাই।’ 

তিনি বলেন, ‘যারাকোল থেকে আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে তাদের বিচার চাই।’

জেসমিনের বাবা রেজাউল হক বলেন, ‘বিয়ের পর আমার মেয়ে দুইটা মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। কিছুদিন আগে আবার একটি মেয়ে জন্ম দেয়। এর জন্য আমার মেয়েকে তালাক দেয় রবিউল। আমার মেয়েকে বিনা অপরাধে সে তালাক দিয়েছে। সে বলে ফাতেমা তার সন্তান না। কিন্তু পরে আবার তার সন্তান বলে আমার নয় দিনের নাতনি ফাতেমাকে কেড়ে নিয়ে গেছে। সে ফাতেমাকে বিক্রি করে দিয়েছে পাশের গ্রামে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ তাতে কোন কষ্ট নেই, আমি নাতনিকে ফেরত চাই। প্রয়োজনে ভিক্ষা করে আমার নাতনিকে মানুষ করব।’

ফাতেমার বড় বোন সালেকী জানায়, ‘আমার ছোট বোনকে আমার বাবা আরেকজনের কাছে বেঁচে দিয়েছে। সেদিন আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গেছে। ফাতেমা কোথায় আমি জানি না।’

রেজাউলের প্রতিবেশী নাসরিন ও রোজিনা বলেন, ‘যেদিন বাচ্চাটা মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেয় সেদিন খুব কান্নাকাটি করেছিল জেসমিন। তবে বিচারে কেউ তার কথা শোনেনি। তার বাচ্চাটাকে তার বাবা বিক্রি করে দিয়েছে। বাচ্চাটার বয়স মাত্র কয়েক দিন। সে মায়ের দুধ পাচ্ছে না। সে কি আদৌ মাকে ফিরে পাবে?’

এদিকে মঙ্গলবার রবিউলের বাড়িতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রবিউলের মা জানান, ‘আমার ছেলেকে অনেকবার নিষেধ করেছি তবে সে শোনেনি। শুনেছি, বাচ্চাটা আয়ূব নামে একজনকে দিয়ে দিয়েছে।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। বিচারে আমি ছিলাম না।’

স্থানীয় মাতব্বর শহিদুল ইসলাম জানান, ‘দুই পরিবারের মধ্যে একটা মনোমানিল্য ছিল। আমরা সেটা দুই লাখ টাকার বিনিময়ে দফারফা করে দিয়েছি।’

শিশুটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাচ্চা আছে। আমরা বিক্রি করে দেইনি।’ 

খলিসাকুণ্ডি ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি শুনেছি শালিশের মাধ্যমে নয় দিনের বাচ্চাকে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। তবে কত টাকায় বিক্রি করেছে আমি জানি না। কীভাবে তার তালাক হলো সেটাও জানি না। তবে এটা ঠিক হয়নি। এটা একটা অপরাধ।’

এ ঘটনায় জেসমিনের বাড়িতে উপস্থিত থাকা দৌলতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজগার আলী বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভাব-অনটন ও পারিবারিক অশান্তি এবং পরপর তিনটি মেয়ে হওয়ায় তাকে তালাক দিয়ে দেয়। বাচ্চাটি নিয়ে যায়। আমি রবিউলের বাড়িতে গিয়ে দেখি সবাই পালিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাচ্চাটিকে তারা ফুপুর কাছে রেখেছিল। তবে এখন কোথায় জানি না। তবে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবে শুনেছি।’

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, ‘কোন শিশুকে বিক্রি করে দেয়ার কোন নিয়ম নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

(ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/প্রতিনিধি/এলএ)