নির্বাচন কোনো উৎসব বা খেলা নয়

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
 | প্রকাশিত : ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৪৯

সবকিছু মিলিয়ে পুরো জাতি এখন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে ধাবমান। আমরা দীর্ঘদিন থেকে সভা, সেমিনার, কনফারেন্স, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এবং টক শোতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছি। যেভাবেই হোক আমাদের এমন একটি নির্বাচন করতে হবে, যেখানে দেশের ছোটবড় সব রাজনৈতিক দল যেন অংশ নেয়। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লোক অবাধে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। বর্তমানে আমরা সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত আয়োজনের শুভ সূচনা দেখতে পাচ্ছি। যদিও বামফ্রন্টের রাজনৈতিক দলগুলোর তোড়জোড় এখনও লক্ষ্যণীয় নয়। বাম দল ছাড়া বাকি সব দল নির্বাচনী মাঠে। তারা এখনও অপেক্ষা করছে। হয়তো তারাও সময় সুযোগ বুঝে নির্বাচনে নেমে যাবে।

যাই হোক সব রাজনৈতিক দল এখন জোটবদ্ধভাবে কিংবা একক দলীয় ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এখন নানা সমীকরণ। নির্বাচন প্রকৃত অর্থেই আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে একটি উৎসবের মতো। গণতন্ত্রের আদি দেশগুলো যেমন-ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচন অনেকটাই নীরবেই হয়ে যায়। অনেকে বিষয়টি টেরই পান না। অনেকে নির্বাচনের কোনো খবরই রাখে না। তাদের কাছে নির্বাচনের গুরুত্ব নেই। ভাবার সময়ও নেই। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই বিরাট সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উৎসব। সর্বত্র আলাপ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক।

অর্থনীতিতে নির্বাচনের গুরুত্ব নেহাত কম নয়। নির্বাচনের আর্থিক লেনদেনের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অনেক বৃদ্ধি পাবে। নির্বাচনে সমতল ভূমির কথা বলা হয়ে থাকে। খেলার মাঠ সমতল হতে হয়। কিন্তু নির্বাচনকে খেলা হিসেবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং নির্বাচন একটি যুদ্ধ। রণক্ষেত্রের মাঠ সব সময় সমান থাকে না। নির্বাচনের নানা বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতেই হবে। সব দলের জন্য যুদ্ধের ময়দান সমান থাকে না। এক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থাকে, তাদের জন্য যুদ্ধ ময়দান খুব একটা সুবিধার থাকে না। অনেক জটিলতা, আলোচনা এবং সমালোচনা লেগেই থাকে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের নির্বাচনী যুদ্ধের মাঠ কিছুটা অমসৃণ। তেমন বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে না। এদিক থেকে বর্তমানে ভালো অবস্থানে থাকে বিরোধী দল। কারণ তারা নির্বাচনের আগে ক্ষমতায় ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে আলোচনা সমালোচনা কম থাকে। ফলে এ বিবেচনায় সরকারি দল বিরূপ অবস্থানে থাকে। সরকারি দলের ভালো মন্দ কাজের ফলে নানা সমালোচনার সুযোগ তৈরি হয়। কাজেই নির্বাচনে সমতল ভূমির কথা বলা হলে বরং সরকারি দল বেকায়দায়। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধী দল ভালো অবস্থানে থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে তৃতীয় বার একই রাজনৈতিক দল ফের ক্ষমতায় এসেছে এমন নজির কমই আছে। এদিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ।

বর্তমানে সভা সমাবেশের ওপর নিধিনিষেধ আরোপ আছে। কিন্তু আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সবাই সভা, সমাবেশ করতে পারবে। নেতাকর্মীদের আটক গ্রেপ্তারও বন্ধ হচ্ছে। আমাদের সংবিধানের ১২৬নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে গেছে। নির্বাচনের আগে পরে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে। নির্বাচনী পরিবেশের মধ্যে অনেকের প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটবে। কারণ নির্বাচন আমাদের এখানে উৎসব। আর উৎসব হলে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ নানা কারণে মারা যাবে। যেমনটি ভারতের ধর্মীয় উৎসবের সময় আমরা লক্ষ্য করে থাকি। নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের আর কোনো জাতি এমন উৎসবে মেতে উঠে না। নির্বাচনের সময় পুলিশ প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। নির্বাচন কমিশনের হাতে গ্রেপ্তার, আটক, শাস্তি দেয়া, বদলি করা এবং অন্যান্য যেসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রয়োগ করতে হবে। আর নির্বাচন কমিশনের উচিত ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ করা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবশ্যই এটা করতে হবে।

তবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সমস্ত অনিয়ম দূর করবে- এমন সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। বরং এই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ থাকা দরকার। কেননা নির্বাচন কমিশনের সেই অর্থে ব্যাপক লোকবল এবং দলও নেই। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পুরো নিয়ন্ত্রণ হয়ত নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকে। কিন্তু ভোটগ্রহণের দিন সকাল থেকেই কমিশনের আর কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। যদিও আমরা নির্বাচনের পরে অনেক মন্তব্য করে থাকি বা করবো। ইসি অনেক কিছুই করতে পারত কিংবা এটা করেনি ওটা করেছে ইত্যাদি।

বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচন কতটা ভালো হবে তার পুরোটাই নির্ভর করছে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয়ভাবে সব সময় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকে এবং পাহারা দেয়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে বাধ্য। কেন্দ্রে কোনো দলের এজেন্টকে বের করে দিলে অন্যেরা বাধা দেবে। অর্থাৎ সব রাজনৈতিক দলের সরব উপস্থিতি কেন্দ্রে থাকবে। ভোটারদের সাহায্য সহযোগিতা করবে। কাজেই সব রাজনৈতিক শক্তি যদি কেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত অবস্থান করে নির্বাচন ভালো হবেই। কেন্দ্রে অবস্থান না করেই যদি কোনো প্রার্থী ভোটগ্রহণ পর্বের মাঝ পথে ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি বক্তব্য দেন এবং বাড়ি চলে যান, তখন নির্বাচন কেন্দ্র বিভিন্ন অপশক্তির দখলে চলে যায়। আওয়ামী লীগ বিএনপি না করলেও এর বাইরেও বহু অপশক্তি ষড়যন্ত্র করে অপকর্ম চালিয়ে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। যার নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা ঠেকানো নির্বাচন কমিশন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়।

নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা রয়েছে, ইসি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রের যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো দায়িত্ব দিতে পারে। ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে জাল ভোট ঠেকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে ইভিএম। কেননা একশ জাল ভোট দিতে গেল একশ ভোটার ও একশ স্মার্ট কার্ড নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া ইভিএমে জাল ভোট দেয়া যাবে না। সেখানে একশ বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ লাগবে। তবে যান্ত্রিক সুবিধার জন্য ইভিএমে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া হবে। কারণ ভোটারদের জাতীয় তথ্যভা-ার কিন্তু সেনাবাহিনী তৈরি করেছে। কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নতুন কিছু হবে না। ইভিএমে মানুষের আগ্রহ আছে। সিটি নির্বাচনে মানুষ লাইন দিয়ে ইভিএমে ভোট দিয়েছে। ইভিএমেও জাল ভোট দেয়ার সুযোগ আছে এমন সন্দেহ থাকলে জাল ভোট ঠেকানো সহজ আর কোনো বুদ্ধি বা প্রযুক্তি নেই।

নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রত্যকে ২৫ লাখ ব্যয় করবেন। অনেক প্রার্থী ইতিমধ্যে এরও বেশি খরচ করছে। ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব রাখতে হলে নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একজন করে অডিটর নিয়োগ দিতে হবে। যা বাস্তবে সম্ভব নয়। কাজেই এমন আইন থাকা ঠিক নয়, বাস্তবায়ন করা যাবে না। অনেকে ব্যাংকে ঋণের টাকার অংশবিশেষ ফেরত দিচ্ছেন। বলা চলে এটা একটা হালখাতা। অতীতের সব নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। এবারও সেনাবাহিনী থাকবে। সাথে একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে পারে। সেনাবাহিনীর হাতে যেহেতু বন্দুক আছে, সেহেতু তাকে কোনো বিচারিক ক্ষমতা দেয়া যাবে না। র‌্যাব যখন অভিযান চালায় তখন তাদের সাথে একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন। রিটার্নিং অফিসার যা নিদের্শনা দেবেন সেই মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করবে। প্রত্যেক বাহিনী নিজস্ব অবস্থানে থাকবে এবং সেনাবাহিনী স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে। নির্বাচন কর্মকর্তা চাহিদা জানাবে, সেই মোতাবেক সব কিছু পাবেন। দৈনন্দিন ঘটনাগুলো দেখার দায়িত্ব পুলিশের। সেনাবাহিনীকে এসব দায়িত্ব দিলে বরং অনেক বিড়ম্বনা বাড়বে। সেনাবাহিনীর কাছে সন্ত্রাসী, অবৈধ অস্ত্রধারী কিংবা মাদকের আসামির তালিকা থাকে না। এগুলো থাকে থানা পুলিশের কাছে। সর্বোপরি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ওয়াদা করতে হবে যে, তারা একটি ভালো নির্বাচন করবে। তবে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশ্রগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :