শহীদ মিলন ভাই অমর হয়ে থাকবেন

ডা. ফরহাদ আলী খান
| আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০১৮, ২২:২৫ | প্রকাশিত : ২৭ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:৩৭

আজ ২৭ নভেম্বর- শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন দিবস। ১৯৯০ সালের এইদিনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিঝরা উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন টিএসসি এলাকায় তৎকালীন স্বৈরশাসকের গুপ্ত বাহিনীর গুলিতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।

ওই দিন সকাল সোয়া ১১টা নাগাদ বিএমএর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন ও মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন রিকশায় পিজিতে যাওয়ার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির পূর্ব কোণায় সন্ত্রাসীদের আক্রমণে পড়েন এবং গুলিতে ডা. মিলন নিহত হন। ডা. মিলন তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং কলেজের বায়োকেমিস্ট বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ (জাসদ) ঢাকা মেডিকেল শাখার সভাপতি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ (ঢামেকসু)-এর ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আমি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি, বাঙালি জাতির ইতিহাসের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে যার আত্মত্যাগের কারণেই স্বৈরাচার নিপাত যায়, গণতন্ত্র মুক্তি পায়। গণবিরোধী স্বাস্থ্য নীতির প্রতিবাদে এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে বিএম এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের নির্দেশে এবং ডা. শামসুল আলম খান মিলন ভাইর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের সকল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ছাত্র সংসদ এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে আমরা গঠন করেছিলাম সর্বদলীয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্র ঐক্য পরিষদ। দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ও জিএস এবং ডেন্টাল কলেজ থেকে দুজনকে নিয়ে গঠন করা হয়েছিল আঠারো সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্র ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি। আমাকে ওই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহ্বায়ক ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস সারোয়ার রোমেলকে সদস্য সচিব মনোনীত করা হয়। এছাড়া আন্দোলনকে সফলভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে সকল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ছাত্রশিবির ছাড়া সকল ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র সংসদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিল সর্বদলীয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্র ঐক্য পরিষদের শাখা কমিটি। এপ্রিল মাস থেকেই বিএমএ এবং সর্বদলীয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে চিকিৎসক সমাজের ঐক্যবদ্ধ লাগাতার আন্দোলন চলছিল।

ডা. মিলন ভাই হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের মেডিকেল ছাত্রসমাজ এবং চিকিৎসকসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিকেল শিক্ষক সমিতির ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ একাডেমিক কাউন্সিলের জররি সভা ডাকা হয়। ডা. মিলন হত্যার বিচার ও এরশাদের পতনের দাবিতে সর্বদলীয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্র ঐক্য পরিষদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাধারণ ছাত্রছাত্রীবৃন্দ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষক এবং মেডিকল শিক্ষক সমিতির সভা ঘেরাও করে রাখে। ছাত্রদের একটাই দাবি ছিল ডা. মিলন হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যাকারী খুনি এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে সকল শিক্ষকের তাৎক্ষণিক পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা। সবগুলো মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এবং ছাত্রসংসদ মেডিকেল শিক্ষক ও চিকিৎসকদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ, ঘেরাও ও সমাবেশ আয়োজন করে। ঘেরাওয়ের এক পর্যায়ে ছাত্ররা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে এবং ছাত্রদের দাবির মুখে বাংলাদেশের সকল মেডিকেল শিক্ষকের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের এক বিক্ষোভ মিছিল প্রেসক্লাব অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ওই মিছিলে যোগ দেন আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা।

প্রেসক্লাবের সামনে আমার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্র ঐক্যের সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর তৎকালীন অধ্যক্ষ ও মেডিকেল শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক কবির উদ্দিন আহমেদ দেশের সকল মেডিকেল শিক্ষকের পদত্যাগের ঘোষণা দেন। বিএমএর নেতৃবৃন্দ, তৎকালীন কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রেসকাবের বিক্ষোভ সমাবেশে যোগদান করেন। বাংলাদেশের আটটি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ এ অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকা হয়। বিএমএ বাংলাদেশের সকল চিকিৎসকের পদত্যাগ এবং বাংলাদেশের সকল হাসপাতাল এ অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়। ডা. মিলনের মৃত্যুসংবাদের খবরে সারাদেশে চেতনার বিস্ফোরণ হলো, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের দাবির পাশাপাশি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। এসময় এরশাদ কারফিউ জারি ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। জনগণ ঘৃণাভরে সেই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে। রাত্রেই কারফিউ ও জরুরি আইন অমান্য করে মানুষের ঢল নামে ঢাকাসহ সারাবাংলার রাজপথে। এভাবে চলতে থাকল লাগাতার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস পরিণত হয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এ ক্যাম্পাসে এ চিরনিদ্রায় শায়িত ডা. মিলন ভাইর সমাধিস্থলে প্রতিদিন মানুষের ঢল নামতে থাকল। প্রতিদিন ছাত্র, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ সকল পেশার মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশে হতে লাগল ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার চত্বরে।

অন্যদিকে সকল হাসপাতালে ধর্মঘট বাস্তবায়নে ছাত্র-চিকিৎসকের সমন্বয়ে দল বেঁধে পাহারা দেয়া হতো, যাতে সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী অবস্থান নিতে না পারে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল ক্যাম্পাস থেকে এরশাদের পেটোয়া বাহিনীকে বিতাড়িত করা হয় এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে আন্দোলনকারী ছাত্র-শিক্ষকদের উপর সরকারি বাহিনীর হামলা প্রতিহত করা হয়। দেশের সকল রাজনৈতিক জোট ও পেশাজীবী সংগঠনসমূহ চলমান আন্দোলনে শরিক হয়ে এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার হরতাল ডাক দেয়।

তৎকালীন ১৫ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, ৫ দলীয় জোটের নেতারা ও ৭ দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে সরকারি কর্মচারীরাও আন্দোলনে শরিক হন। ৩ ডিসেম্বর রাতে সামরিক সরকার নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে শেষ চেষ্টা চালায়। সকল সংগঠন ও জোট এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে রাস্তায় নেমে আসে। উপায়ন্তর না দেখে স্বৈরাচারী এরশাদ ৪ ডিসেম্বর রাতে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। ওই রাত্রে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমে ছিলাম। এরশাদের পদত্যাগের সংবাদে আমরা শতশত মেডিকেল ছাত্র-শিক্ষক বিজয় মিছিল নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে প্রেসক্লাবের সামনে যাই। আমাদের বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রেসক্লাব পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সমাবেশ থেকে সবাই ছুটল মন্ত্রীপাড়ার দিকে গণদুশমনদের খোঁজে।

দেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে চিকিৎসক সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রবৃন্দ এবং ছাত্র সংসদের উদ্যোগেই নির্মিত হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার। ঠিক তেমনি এই কলেজের সাবেক ছাত্র এবং ঢামেকসুর সাবেক নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিজের জীবন উৎসর্গ করে উপহার দিয়েছিলেন স্বৈরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রা।

১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল একের পর এক সামরিক শাসন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে দীর্ঘ পনেরো বছর অবসান হয়েছিল সেই স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের। ডা. মিলন ভাই বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন এবং যুগ যুগ ধরে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। আজকের এই দিনে আমি মিলন ভাইর প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। স্মরণ করি, সকল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের সকল সহযোদ্ধাদের- যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মিলন ভাই হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন এবং ৯০-এর গণ আন্দোলনকে সফল করেছিলেন।

সাধারণ সম্পাদক, সুইডেন আওয়ামী লীগ

সাবেক ঢামেকসু ভিপি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :