অশান্ত পশ্চিম এশিয়া ও সৌদি আরবের ভূমিকা

এ এস এম আলী কবীর
 | প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৫৩

মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি দিন দিন অশান্ত হয়ে উঠছে। কয়েক বছর পূর্বে গণতন্ত্রের দাবিতে কয়েকটি আরব দেশে আরব বসন্ত নামে অভিহিত ও গণআন্দোলনের পরে এখন আবার কয়েকটি দেশেই পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এবারের কারণ কোনো গণআন্দোলন নয়। বরং দেশে দেশে চলমান গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক সংঘাত।

আরব বসন্ত গণণতন্ত্রের দাবিতে গড়ে উঠলেও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশেই গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। বরং আরব বসন্ত মিসরকে পুনরায় একনায়কতন্ত্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং লিবিয়া আরব বসন্তের দগদগে ঘা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। মিসর চরমপন্থী ধর্মীয় উগ্রবাদের হাত থেকে আপাতত রেহাই পেয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু একই সঙ্গে সুদূরপরাহত হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য গণআকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন। আর লিবিয়ায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলমান রয়েছে। যার মূলে রয়েছে গোত্র হিংসার বিষাক্ত ভাইরাস।

আরব বসন্ত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করেছে এই অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশ ইয়েমেনে। অথচ বহু বছর পূর্বে একত্রীভূত উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন এতদিনে অপেক্ষাকৃত উন্নত ও অগ্রসর দেশে পরিণত হওয়ার কথা ছিল। গণতন্ত্রের জন্য সেদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহের গদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তিনি ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচনের দিতেও সস্মত হন। কিন্তু বাধ সাধে সেখানেও গোত্র হিংসা এবং সেই সাথে যুক্ত হয় শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় বিভাজন। দেশের শিয়াপন্থী বৃহত্তর হুতি সম্প্রদায়ের সপক্ষে ইরান সমর্থন ঘোষণা করলে সৌদি আরবও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।

ইয়েমেনের অবস্থা এখন এতটাই শোচনীয় যে কার্যত সেখানে কোনো সরকারের অস্তিত্ব নেই। দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ দেশের দুর্বল অবকাঠামো প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। এই যুদ্ধে সৌদি আরব বিমান থেকে ক্রমাগত বোমা বর্ষণ করার ফলে ইয়েমেনের অনেক অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। দেশটি ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষাবস্থার সম্মুখীন এবং লাখ লাখ শিশু অনাহারের সম্মুখীন। মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা এবং সৌদি অসহযোগিতার ফলে ইয়েমেনের শিশুদের জন্য ইউনিসেফ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থা জরুরি ত্রাণ তৎপরতা চালাতে পারছে না। ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধে নির্মমতার সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবং সেখানে সৌদি বিমান বহর হুতি বিদ্রোহী কবলিত এলাকায় জানাজা অনুষ্ঠানেও বোমা বর্ষণ করতে পিছপা হচ্ছে না। এবং তাতে ব্যাপক প্রাণহানি হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সৌদি সংশ্লিষ্টতার আরেটি বড় দৃষ্টান্ত প্রতিবেশী আঞ্চলিক উপ পরাশক্তি ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের ক্রমাগত ও দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দের কারণে উভয় দেশই ব্যাপক রণসজ্জা ও অস্ত্র ক্রয়ের দিকে ঝুকে পড়েছে। দুটি দেশই তেলসম্পদে সমৃদ্ধ এবং এই সম্পদ জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত না হয়ে অস্ত্রসজ্জায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কারণে সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) এর আওতাভুক্ত দেশগুলো প্রতিবেশী কাতারকে এক ঘরে করেছে এবং ওই দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। শুধু তাই না দেশটিকে অন্যায় ও অন্যায্য একটি দাবিনামা দিয়ে সেগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কাতার অবশ্য এসব দাবি মেনে নিতে তেমন আগ্রহী নয়। কারণ সেক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা ও উন্নয়ন উভয়ই বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে তাদের ধারণা।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই একমাত্র শিয়া অধ্যুষিত দেশ নয়। ইরানে জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই শিয়া সম্প্রদাভুক্ত। কিন্তু এ ছাড়াও শিয়ারা সংখ্যাগুরু এবং এমন আরো দেশ সেখানে রয়েছে। এদের একটি হচ্ছে ইরাক এবং অপরটি দ্বীপ রাষ্ট্র বাহরাইন। ইরাক এখনো উপসাগরীয় যুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে উঠতে পারেনি। তবে হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কমেছে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে যে তারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইরাকে সৌদি আরব বা অন্য কোনো আরব দেশের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু আইএসআই নামক চরমপন্থী ও হিংসাশ্রয়ী উগ্র যোদ্ধা বাহিনীর তৎপরতা এখনে অব্যাহত রয়েছে, যদিও সাম্প্রতিককালে তারা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই আইএসআইয়ের পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের গোপন সমর্থন রয়েছে বলে অনেকেই সন্দেহ করেন।

পশ্চিম এশিয়ার এই সময়ের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের নাম সিরিয়া। সিরিয়ার সংঘাতে আরব বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো, ইরান, ইসরাইল, আইএসআই এরা সকলেই কমবেশি জড়িত। এছাড়া বিশ্বের দুটি পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এই সংঘাতে পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়ার সংঘাতে রাশিয়ার অব্যাহত উপস্থিতি দিন দিন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য উদ্বেগের কারণ। সিরিয়ার সংঘাতে স্বল্প মাত্রার হলেও আরেকটি অনারব রাষ্ট্র জড়িত। সেটি হচ্ছে তুরস্ক। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রথম মহাযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তুরস্কের অটোমান সা¤্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল ইরান ব্যতীত প্রায় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। সুতরাং পুরনো শাসক হিসেবে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে তুরস্কের একটি ভূমিকা এখনো রয়েছে। হয়ত এই কারণেই প্যালেস্টাইনি ভূমি বৃটিশ কর্তৃক বিভক্ত হয়ে পশ্চিমা শক্তিবর্গের মদদে ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলে তুরস্ক কালবিলম্ব না করে তাকে স্বীকৃতি জানায় এবং তুরস্কই হচ্ছে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী মুসলিম অধ্যুষিত প্রথম দেশ। গত শতাব্দীর ৭০ ও ৮০ দশকের সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধের স্মৃতিবাহী লেবানন এখন অপেক্ষাকৃত শান্ত একটি দেশ, কিন্তু সম্পূর্ণ শান্ত নয়। সেখানে বিশেষ করে ইসরাইলের সঙ্গে সীমান্ত প্রায়ই অশান্ত হয়ে উঠে। এর প্রধান কারণ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে হেজবুল্লাহ নামক শিয়া মিলিশিয়াদের আধিপত্য। স্পষ্টতই এই মিলিশিয়ারা ইরান সমর্থিত। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও ইরানের একটি ভূমিকা রয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পক্ষে লড়াই করার জন্য ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘাঁটিগুলো ইসরাইলি বিমান হামলার লক্ষবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। যা কি না আবার সৌদি আরবের জন্য পরম স্বস্তিদায়ক। এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘাতের জটিল সমীকরণ পুরোনো শত্রুকেও নতুন মিত্রতার সন্ধান দিয়েছে।

পৃথিবী পরিবর্তনশীল। মধ্যপ্রাচ্যও তাই। মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে অপরিবর্তনীয় দেশ সৌদি আরবও এখন পরিবর্তনশীল সময়ের মুখোমুখি। তারা বিদ্যমান সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য কিছু কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের সূচনা করেছে। মহিলাদের ভোটাধিকার এবং গাড়ি চালনার অধিকার দেয়া হয়েছে। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো পুনরায় জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আরও বেশ কিছু পরিবর্তন ও সংস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনশীল আবহের মধ্যে অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে একটি অশুভ ঘটনা। তাদের প্রাক্তন শাসক তুরস্কের ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত বিখ্যাত নগরী ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটে প্রবেশ করার পর রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান প্রখ্যাত সৌদি লেখক ও সাংবাদিক জামাল খাসোগি। এই ঘটনা নিয়ে গত দেড় মাস সমগ্র বিশ্ব তোলপাড়। স্পষ্টতই জনাব খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ গুম করে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনার জন্য সন্দেহের তীর এখন সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের দিকে। এর ফলে তার ভবিষ্যতে রাজা বা মালিক হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। তার গদি ইতিমধ্যেই অনেকটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। যদিও তিনি তার ৮২ বছর বয়সী পিতা বাদশা সালমানের অতি প্রিয় পুত্র।

সৌদি আরব সম্প্রতি সাধিত সংস্কার যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে সাধিত হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে এখন খাসোগি হত্যায় তার কথিত ভূমিকার কারণে শুধু তার নিজের নয় সৌদি রাজতন্ত্রের ভবিষ্যতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। ইরানের সাথে দ্বন্দে¦ শক্তিশালী মিত্রকে পক্ষে পাওয়ার অভিলাসে সৌদি আরব গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলছে বলে অনেকে মনে করেন। এমনকি আশির দশকের গোড়ার দিকে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দিনে দুপুরে ইসরাইলি বিমান হামলার পেছনে সৌদি সহায়তা কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। এই ধরনের অভিযোগের তীর সৌদি আরবের দিকে বহুদিন ধরেই রয়েছে। এর ওপর খাসোগি হত্যার অভিযোগের তীর স্পষ্টতই সৌদি যুবরাজ সালমানের দিকে ধাবিত হওয়ায় সৌদি রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নড়বড়ে হয়ে পড়তে পারে বলে মনে হয়।

লেখক: সাবেক সচিব, কবি ও প্রাবন্ধিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :