এইডস রোগীদের ভয় ‘নিগ্রহ’

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ২০:৪১

দীপান্বিতা রায়

এইচআইভি ভাইরাস বা এইডস রোগে আক্রান্তদের এখনো একঘরে করে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশে। এমনকি চিকিৎসা নিতে গিয়েও বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে দেশে এখনো এ রোগে আক্রান্তদেরই দায়ী করা হয়। সামাজিকভাবে অপমান আর নিগ্রহের পাশাপাশি পরিবারেও অবাঞ্চিত হয়ে পড়েন তারা। তবে বৈষম্যমূলক আচরণের পরিবর্তে যথোপযুক্ত চিকিৎসা পেলে এ রোগে আক্রান্তরাও অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

এইডস বিশ্বে মরণব্যাধি হিসেবে পরিচিত। প্রায় সব দেশেরই এ রোগে আক্রান্তদের তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়। এমনকি আক্রান্তের পরিবারকেও সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। ফলে সংক্রমিত হয়েও অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে নিজেকে চিকিৎসা থেকে দূরে রাখেন।

এমনই একজন রাইসা খানম (ছদ্মনাম)। তার শরীরে এইডস ধরার পর তাকে ছাড়তে হয়েছে নিজ এলাকা। এমনকি তার পরিবারকে এড়িয়ে চলত সমাজের লোকজন। তিনি এখন নিজের রোগের কথা গোপন করে অন্য এলাকায় গিয়ে বসবাস করছেন। অথচ তার এ রোগটির জন্য তিনি নিজে দায়ী নন। প্রবাসী স্বামীর কারণেই এই রোগটি বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। স্বামী দীর্ঘদিন বিদেশে থেকেছেন এবং সেখান থেকেই তিনি এই রোগটি বয়ে আনেন। একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়।

রাইসার মতো এমন অনেক এইডস আক্রান্ত রোগী আছেন যাদের ভীষণভাবে অবহেলিত হতে হয়। চিকিৎসা নেওয়া দূরে থাক, লজ্জায় এই রোগের কথা স্বীকার করতেই চায় না কেউ। ফলে চিকিৎসার অভাবে অকালেই মারা যায় অনেক রোগী। আবার অনেকেই পরীক্ষা না করানোর কারণে জানতেই পারেন না তাদের শরীরে এই ভয়াবহ ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। এইডসের কথা জানাজানি হলেই সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে তারা চিকিৎসা নেন গোপনে। এমনকি কেউ কেউ অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করতেও বাধ্য হন।

জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ রোগীই ওষুধ পাচ্ছে না। কারণ পরীক্ষা না করানোর ফলে তারা জানতেই পারছেন না আক্রান্ত কিনা।

যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে তালিকাভুক্ত মোট এইডস রোগী ৫ হাজার ৫৮৬ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে শনাক্ত হয়েছে ৮৬৫ জন। তাদের ১২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এ পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত ৯২৪ জন মারা গেছে এ পর্যন্ত দেশে। তবে এর বাইরে একটা বড় অংশের রোগী তালিকার বাইরে রয়েছে। এখনো পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি এমন রোগীদের তালিকায় আনা গেলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।

বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়সহ মোট ১২টি সরকারি হাসপাতালে এইডস রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসাসেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যারা এইডস রোগীদের শনাক্তকরণ, চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে।

এইডস নিয়ে কাজ করছে ‘আশার আলো সোসাইটি’ নামের একটি এনজিও। তারা দীর্ঘদিন ধরে দেশের এইডস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন। চিকিৎসার নিতে সহায়তার পাশাপাশি এইডস রোগীদের পুনর্বাসনও করে এনজিওটি।

আশার আলোর নির্বাহী পরিচালক ডা. নিলুফার বেগম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এইডস পরীক্ষা করাতে অনেক রোগী আসে। এমনকি কলেজপড়ুয়া অবিবাহিত মেয়েরাও আসে। আমরা পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করি। আমরা তাদের বোঝাই লজ্জার কিছু নেই, সন্দেহ থাকলে অবশ্যই পরীক্ষা করানো উচিত।’

আশার আলোতে চাকরি করেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এমন একজন এইচআইভি সংক্রমিত ঢাকা টাইমসকে জানান, নিয়মিত ওষুধ খেয়ে তিনি এখন বেশ ভালো আছেন। চাকরি করছেন। অথচ তিনি একসময় ভাবতেই পারেননি যে, বেঁচে থাকবেন।

এইডস ঠেকাতে উপযুক্ত চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মূলত দুটি কারণে এইডস ছড়ায়। যৌনকর্মীদের মাধ্যমে আর প্রবাসীদের মাধ্যমে। এদের সচেতন করা গেলে এইচআইভি সংক্রমণ হ্রাস করা সম্ভব।’

‘এ ছাড়া চিকিৎসাসেবার ব্যাপারে সরকারকে আরও সহযোগিতাপূর্ণ হতে হবে। এইচআইভি এর ওষুধ খুবই ব্যয়বহুল। এটি দেশের সাধারণ ফার্মেসিগুলোতে পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র ঢাকার কিছু হাসপাতালে পাওয়া যায়। ঢাকাকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সরকার অন্তত প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এইচআইভি ওষুধ বিতরণের ব্যবস্থা করলে আক্রান্তদের পক্ষে সুবিধা হয় সেবা পেতে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার এবং অন্যান্য সামাজিক শক্তি ও সংগঠন সমন্বিত উদ্যোগ নিলে আর এইডস রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা, আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক নিগ্রহ ও বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশে এইডস সম্পৃক্ত মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

ঢাকাটাইমস/০১ডিসেম্বর/ডিএম