শিক্ষার মানোন্নয়নে একজন শফিকুর রহমান

লাভলু পাল চৌধুরী, নেত্রকোণা
 | প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৫৯

নিবেদিতপ্রাণ মানুষের কারণে শিক্ষার মানের যে উন্নয়ন হয়, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নেত্রকোণা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা রহিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। ঝরে পড়া রোধ করে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ও পাসের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিদ্যালয়টি এখন আদর্শ বিদ্যাপীঠের মর্যাদা পাওয়ার অপেক্ষায়।

আর মাত্র আট মাসেই নিজের মেধা-পরিশ্রম, সুপরিকল্পিত নানা পদক্ষেপ আর অকাতর সহায়তা দিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক, শিক্ষকসহ পুরো এলাকাবাসীর আস্থা ও স্বপ্নপূরণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন এই শিক্ষানুরাগী।

গত এপ্রিল মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন তিনি। অল্প এই সময়েই তার প্রণোদনামূলক ব্যতিক্রমী কার্যক্রম শিক্ষার মানোন্নয়নে সাড়া ফেলেছে। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় তার সঙ্গে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অন্য সবাইও।

প্রথমেই পাসের হার, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও আর্থিক অবস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেন শফিকুর। এরপর বিদ্যালয়টিকে আদর্শ বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

লক্ষ্য অর্জনে কাজে নেমেই অনুপস্থিতদের বাড়িতে বাড়িতে নিজে গিয়ে ও মোবাইলে যোগাযোগ করে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের স্কুলের বেতন পরিশোধ ও এসএসসির ফরম পূরণে আর্থিক সহায়তা ও শিক্ষা উপকরণ হিসেবে টেস্ট পেপারস বিতরণ করেন। প্রতি রাতে মোবাইলে এসএসসি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ও পড়ালেখার খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও ভালো ফলাফলে শফিকুর রহমানের উদ্যোগের সুফল মিলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।

১৯৬৬ সালে এলাকায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে শিক্ষানুরাগী-সমাজসেবক রহিম উদ্দিন জমি দান করে রহিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা ও নিজের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা শুরু করেন। ঠাকুরাকোণা গ্রামের মরহুম আব্দুর রহমানের বড় ছেলে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শফিকুর রহমান প্রতিষ্ঠাতা রহিম উদ্দিনের নাতি।

এসএসসি পরীক্ষার্থী বিশ্বজিৎ দাস বলে, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে এই স্কুলে লেখাপড়া করছি। সভাপতি আমাদের আর্থিকসহ সবদিকে সহযোগিতা করে আসছেন। আমাকেসহ অনেক গরিব-অসহায় শিক্ষার্থীকে ফরম পূরণের টাকা ও টেস্ট পেপারস দিয়েছেন। তিনি ফোন দিয়ে আমাদের লেখাপড়ার খোঁজ নেন। ভালো জায়গায় পড়াশোনা করা যেসব বড় ভাইদেরও অনেক সহায়তা করেছেন এবং এখনো করছেন। এতে আমাদের পড়ালেখায় আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ভালো ফলাফল উপহার দিয়ে নিজেকে উন্নতির শিখরে নিতে মনে নতুন আশাও জেগেছে।’

নুরনাহার আক্তার সাথী বলে, ‘রাতে আগে কম সময় পড়তাম। কিন্তু আমাদের সভাপতি রাত ১০-১১টা বা যেকোনো সময় মোবাইলে খোঁজ নেন এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। এখন আগের চেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে হয়। তিনি আমাদের আরও আশ্বস্ত করেছেন যে ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করবেন।’

প্রশান্ত চন্দ্র দাস বলে, ‘সভাপতি এক সেট করে বই দিয়েছেন, যা পাওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম। আমার বাবা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তিনি আমার আসন্ন এসএসসির ফরম পূরণের টাকা দিয়ে সহায়তা করেছেন।’

সৃষ্টি সাহাও এই স্কুলের পরীক্ষার্থী। সে বলে, ‘তার এসব উদ্যোগ অনেক ভালো। আমরাও ভালো ফলাফল উপহার দিতে যথাযথ চেষ্টা করব। সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে পরবর্তী ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আরও উৎসাহিত হবে।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে এম সাদেকুর রহমান বলেন, ‘এমন মহৎ উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ এলাকার সবার মাঝে অনুপ্রেরণার মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন সভাপতি। শিক্ষার মান উন্নয়নে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।’

অভিভাবক প্রদীপ চন্দ্র ও বেলা রানী বলেন, ‘আমাদের মতো গরিব মানুষের পাশে থেকে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে সভাপতির বিভিন্ন সহযোগিতা এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ। গ্রামের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ ও বিদ্যালয়ের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করে শিক্ষার মান উন্নয়নে এমন শিক্ষানুরাগী মনোভাব ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। আমরা মনে করি, আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনেক ভালো করবে, সুশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষাক্ষেত্রেও তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

শফিকুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও শহর আর গ্রাম পর্যায়ে কিছুটা পার্থক্য রয়ে গেছে। গ্রামের মানুষের অসচেতনতায় জেলার শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে। আমরা যারা স্কুল পরিচালনা কমিটিতে থাকি, তাদেরও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’

‘আমি স্কুল কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পাসের হার শতভাগ নিশ্চিতে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ বই এবং দরিদ্র-মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়ালেখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তাদের বোর্ড ফি জমা দিতে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। ফলে আমাদের এলাকার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে পড়াশোনায় ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আশা করছি, অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। প্রতিটি স্কুল কমিটির সদস্যদেরও এ ধরনের কার্যক্রম, উদ্যোগ নিতে আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি। এর ফলে স্কুলে উপস্থিতির হার বাড়বে ও শিক্ষার মান উন্নত হবে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :