‘পাকিস্তান গিয়ে বুঝেছি বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কতটা যথার্থ’
সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় দেশমাতৃকার টানে ছুটে গিয়েছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনে। মৃত্যুর মুখে যুদ্ধ করেছেন দীর্ঘ নয় মাস। অস্ত্রের প্রকট শব্দে হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি। আছে সহযোদ্ধাদের হারানোর যন্ত্রণাও। তবে যুদ্ধের ময়দান থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার সুখবর নিয়ে ফিরেছিলেন সার্জেন্ট (অব.) মো. হাসান। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার এই মুক্তিযোদ্ধা সেই স্মৃতির কথা তুলে ধরেছেন ঢাকা টাইমসের কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু বলবেন?
ক্যান্টনমন্টে থেকে বিভিন্ন জায়গায় ফোর্স পাঠানো হচ্ছিল। আমি আর যাইনি। ২৫ মার্চ রাতে যখন অনিবার্য যুদ্ধ লেগে গেল, আমরা পরদিন রওনা হই। আমাদের সদরঘাটে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেখানে যাইনি। কারণ, প্রথম বা অষ্টম রেজিমেন্টের অনেক সেনাকে পাকিস্তানিরা সেখানে হত্যা করে। ফেনীর ছাগলনাইয়া হয়ে বিলোনিয়ার চোত্তাখোলায় পৌঁছালাম।
কীভাবে গেলেন এই পথ?
পুরো পথ হেঁটেই যেতে হয়েছে। তখন বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী। আবার আমরা ১১-১২ জনের একটা বড় গ্রুপ। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ও ছিল। সে কারণে সারা রাত হাঁটতে হয়েছে। দিনের বেলায় সেভাবে পথে বের হওয়ার সুযোগ ছিল। দিনেও অনেক জায়গা পাড়ি দিয়েছি।
কোনো বিপদ হয়েছিল?
চোত্তাখোলায় পৌঁছানোর পর মুক্তিবাহিনী আমাদের ১১ জনের চোখ বেঁধে ফেলে। তখন মনে হলো আর হয়তো বাঁচব না। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলবে। কারণ রাজাকাররাও তথ্য নিতে আসে। কে আসল কে নকল পার্থক্য করা কঠিন। পরে আমাদের পরিচয় পাওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে সবার চোখ খুলে দেয়। তখন মনে হলো নতুন জীবন পেলাম।
সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরিতে এলেন কীভাবে?
আমার সেনাবাহিনীর চাকরিতে জয়েন করার একটা ইতিহাস আছে। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু এক জনসভায় আইয়ুব খানকে বলেছিলেন, ‘আইয়ুব খান সাহেব! আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ কোটি মানুষ হয়েও মিলিটারিতে ৯৫ ভাগ, আর আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা সাত কোটি হয়ে চাকরিতে মাত্র ৫ ভাগ কেন?’ এর পর থেকেই মিলিটারিতে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে।
আমি ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টে জয়েন করি এর পরের বছর। ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে।
পাকিস্তান গিয়েছিলেন কখনো?
মিলিটারি (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) প্রশিক্ষণ হতো পাকিস্তানে। আমারও সে কারণেই পাকিস্তানে যাওয়া। সেখানে গিয়ে দেখি, তাদের সঙ্গে আমাদের জীবনমানের পার্থক্য ছিল আকাশ-পাতাল। তাদের এখানে স্বর্ণের ভরি ৮২ টাকা আর আমাদের এখানে এসে দেখি ১০২ টাকা। আমাদের দেশে তৈরি হওয়া টু-বাই-টু একটা সাদা কাপড় পাকিস্তানে বিক্রি হচ্ছে আট আনা গজ, আর আমাদের এখানে ১০ আনা গজ। তখনই মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন আর বার্তাগুলো কতটা যথার্থ।
দেশে ফিরলেন কখন?
১৯৭০-এর নভেম্বরে বন্যায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমি তখন তিন মাসের ছুটিতে লাহোর থেকে বাড়িতে চলে আসি। ডিপার্টমেন্ট থেকে আমার ছুটি আরও এক মাস বাড়িয়ে দেয়। এই করতে করতেই মার্চ মাস চলে আসে। দেশ তখন উত্তাল। আমরা ছুটি শেষ হলে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঢাকায় ট্রানজিট ক্যাম্পে (এখন যেটা আইএসএসবি) যোগ দিই। সেদিনই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ বাঙালি সেটাই করেছে।
যুদ্ধে কোনো বিশেষ ঘটনা মনে আছে?
অনেক ঘটনা ঘটেছে এই নয় মাসে, তবে দুটি ঘটনা মনে হলে এখনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। আমাদের সঙ্গে ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট এমদাদ সাহেব। তিনি আগে বিমানবাহিনীর করপোরাল ছিলেন। দুর্দান্ত সাহসী লোক। আমরা কদমতলা ক্যাম্প থেকে সিলেটে লাঠিটিলায় যাব অপারেশনে। চা-বাগানের ওপারে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। পেছন থেকে আক্রমণ করব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু চা-বাগানের রাস্তা ভুল করে আমরা পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পের সামনে চলে এসেছি। এমন সময় মেশিনগানের শব্দ শুনতে পাই। তখন টিপ টিপ করে বৃষ্টিও পড়ছে। এমদাদ সাহেব বাম হাত দিয়ে নাভি বরাবর ধরলেন। আবার মেশিনগানের আঘাত। হাতের ঘড়িটা চূর্ণ হয়ে গেল, শুধু ঘড়ির বেলটা লেগেছিল। পরে এই বেল্টসহই তাকে দাফন করা হয়। এই অপারেশনের আগে তিনি বলেছিলেন পাকিস্তানি ধরে এনে আমরা খানা খাব।
আরও একটা ঘটনা আছে বলেছিলেন।
সিলেটের কমলগঞ্জে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প ছিল। আমরা তখন অ্যাটাক করি। তবে সেখানে কাউকে পাইনি। ততক্ষণে পাকিস্তানি আর্মিরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিডিআরের জিল্লুর রহমান (ল্যান্স করপোরাল) ভবনের ওপর থেকে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগটা নামিয়ে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ লাগিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘জয় বংলা’। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের ভেতর থেকে ব্রাশফায়ারে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তখনো একজন পাকিস্তানি মিলিটারি ঘুমিয়ে ছিল। তাকে আমরা দেখিনি। সম্ভবত সে সকালে পালাতে পারেনি। জিল্লুর ভাইয়ের ‘জয় বাংলা’ চিৎকার সে সহ্য করতে পারেনি। জিল্লুর ভাই আর এমদাদ সাহেবের কথা ভুলতে পারি না।
শ্রবণশক্তি হারালেন কীভাবে?
একদিন বিকট আর্টিলারের শব্দে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বোমাটা আমাদের ক্যাম্পের খুব কাছেই পড়েছিল। তারিখটা ঠিক মনে নেই। এর পর থেকে এমন শব্দ শুনলেই কানটা একধরনের বিকট শব্দ হতো। এর পর থেকে খুব আওয়াজ করে শব্দ করে না বললে ঠিকঠাক শুনতে পাই না। ডাক্তার দেখিয়েছি, তাতেও কাজ হয়নি। এখন এভাবেই চলে যাচ্ছে।
এরশাদের সঙ্গে ছিলেন একসময়।
এরশাদ সেনাপ্রধান থাকার সময় থেকে তার সঙ্গে ১১ বছর ছিলাম। তিনি জেল থেকে বের হয়ে আমাকে তার কাছে রাখার বহু চেষ্টা করেছেন। আমি বলছি, স্যার আমি চোখে কম দেখি। আসলে কিন্তু এটা ঠিক নয়। আমি তো আওয়ামী লীগের কর্মী, আমি তার সঙ্গে থাকব কেন?
এখন কেমন লাগছে?
অনেক শান্তি বোধ করছি। যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছি, সেই দলটি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়।