লঘু পাপে গুরু দণ্ড!

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৭

বাবা-মায়ের চোখের পানি কোনো সন্তানের জন্যই মেনে নেওয়ার মতো নয়। তার ওপর এর কারণ যদি হয় সন্তান নিজেই, তাহলে না যায় বলা, না যায় সওয়া। অরিত্রী অধিকারীও সহ্য করতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি বাবার সঙ্গে শিক্ষকদের আচরণ। সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিয়েছে মেয়েটি।

অরিত্রীর বাবা-মায়ের কত স্বপ্নই না-ছিল। মেয়েটির সুন্দর একটা জীবন চেয়েছিলেন তারা। তাই তো প্রতিযোগিতার দৌড়ে অংশ নিয়ে মেয়েকে দিয়েছিলেন ‘ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ বলে খ্যাত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। মনে করেছিলেন, এখানে পড়ে তার সন্তান সফল একজন মানুষ হবে। ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন হবে আলোকিত। হায়! তিনি যদি জানতেন সফলতার আলো জ্বালতে গিয়ে সন্তানের জীবনের আলোই নিভে যাবে, তাহলে কি এখানে ভর্তি করাতেন মেয়েকে?

অরিত্রীর কাছের বন্ধুটি, সহপাঠী, সই কিংবা বান্ধবী। অরিত্রীর মলিন মুখ যাদের হৃদয়ে দাগ ফেলেছে, সহসা কি মুছবে? চাইলেই কি ভুলতে পারবে হাসিমুখ মেয়েটির কথা? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় পাতায় মেয়েটির কত ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও এতটুকু দুঃখ নেই। শরতের আকাশের মতো। শুভ্রতার হাসিমাখা। চুলে কাঠগোলাপ গুঁজেছিল অরিত্রী। আহা! বাবা-মায়ের হৃদয়টা বুঝি খান খান হয়ে যায় মনে হতেই।

পরীক্ষায় মুঠোফোনের মাধ্যমে নকলের অভিযোগ ছিল নবম শ্রেণির অরিত্রীর বিরুদ্ধে। এটি অবাঞ্ছনীয়। এ জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া অন্যায় হতো না। কিন্তু মানসিকভাবে হেনস্তা করা কি ঠিক ছিল? শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক আঘাত সবাই সইতে পারে না। শরীরের আঘাতের ক্ষত হয়তো চিকিৎসায় মুছে যায়; কিন্তু মনের ক্ষত সহসা যায় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ অরিত্রীর বাবার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তা কি বাঞ্ছনীয় ছিল? এই দায় কি কর্তৃপক্ষ চাইলেই এড়াতে পারবে?

সহপাঠী হারানো শিক্ষার্থীরা টানা তিন দিন পরীক্ষা রেখে রাস্তায় নেমেছে। অরিত্রীর আত্মহত্যার জবাব চেয়েছে। ছয় দফা দাবি উঠেছে কোমল কণ্ঠে। এর মধ্যে অরিত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধে অধ্যক্ষের পদত্যাগ ও শাস্তি চেয়েছে তারা। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আচরণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে মানসিক স্বাস্থ্যের বিবেচনা করে আলাদা যত্ন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ চেয়েছে। তৃতীয়ত, কথায় কথায় বহিষ্কারের যে হুমকি দেওয়া হয়, এটি বন্ধের পাশাপাশি ডিটেনশন পলিসি বন্ধ করার দাবি জোরালো হয়েছে।

চতুর্থত, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং কর্মরত সবার মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে মানসিক পরামর্শদাতা চেয়ে শিক্ষার্থীরা। শৃঙ্খলাভঙ্গকারী শিক্ষার্থীকে হুমকি-ধমকি নয়, প্রয়োজনীয় পরামর্শ চেয়েছে। এ ছাড়া গভর্নিং বডির সদস্যদের পদত্যাগ ও অরিত্রীর বাবা-মায়ের কাছে অধ্যক্ষ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে।

শিক্ষকরা আশ্বস্ত করেছেন, ধাপে ধাপে তাদের এ দাবি মেনে নেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা আস্থা রেখেছে। এই আস্থা যেন ক্ষুণœ না হয়। কর্তৃপক্ষকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেন সবার জন্য এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

অরিত্রী জীবন দিয়ে আমাদের সবার চোখ খুলে দিয়েছে। দক্ষ ও কঠোর প্রশাসন, একটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুশৃঙ্খলভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চলতে হলে, দক্ষ প্রশাসনের বিকল্প নেই। তাই বলে কঠোরতার নামে মানবিকতা বিবর্জিত কোনো আচরণও গ্রহণযোগ্য নয়। অরিত্রীর আত্মহত্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, কঠোর প্রশাসন মানেই দক্ষ প্রশাসন নয়। দক্ষ প্রশাসন তাকেই বলা চলে, যেখানে সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতা দুই পক্ষের স্বার্থই রক্ষা হয়।

এখন সময় এসেছে, প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের অবৈধ ও আরোপিত বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছিল। এটিও এখন সুরাহা হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি। সরকারের তরফ থেকে একজন দক্ষ অধ্যক্ষ নিয়োগ করা প্রয়োজন।

আমরা চাই না আর কোনো অরিত্রী আমাদের চোখে জল আনুক। আর কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি হোক। স্বপ্নভঙ্গের মিছিল আর চাই না। অরিত্রীদের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী চাই। লঘু পাপে গুরু দণ্ডের সংস্কৃতি বন্ধ হোক। বন্ধ হোক কোমলের প্রতি কঠিনের কশাঘাত। যারা আগামীর বাংলাদেশ গড়বে, তাদের প্রতি সহায় হোন। আরো মানবিক হোন। অপরাধের শাস্তি দিন, কিন্তু এই শাস্তি যেন আর জীবনের বিনিময় না হয়।

অরিত্রীর সহপাঠীদের কথা কি কেউ ভেবেছে? ক্লাসরুমের দিকে তাকাতে যখন তাদের মনে হবে, এই তো এখানেই বসত অরিত্রী। গা ঘেঁষে বসা বন্ধুটি বলবে, ঠিক আমার পাশেই। তখন কি অরিত্রী-শূন্য ক্লাসরুম মেনে নিতে পারবে তারা?

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :