এমন নিঃশব্দেও মানুষ চলে যায়

প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:১৬

সৈয়দ ইকবাল
আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন (৬ অক্টোবর ১৯৪৮―১ ডিসেম্বর ২০১৮)

বাংলাদেশের আধুনিক ফটোগ্রাফির জনক আনোয়ার হোসেন তেমনি আচমকা নিঃশব্দে চলে গেলেন। খুবই নিঃসঙ্গ একা মধ্য রাতে ঢাকার পান্থপথের একটি সাধারণ হোটেল কক্ষে। চোখে হয়তো বারবার ভেসে উঠেছিল দু চোখের দুই মণি আকাশ আর মেঘদূতের মুখ।

তার হৃদয়ের অবস্থা ভালো ছিল না। ডায়াবেটিসও ছিল। তিনি প্যারিসের ভালো হাসপাতালে বিনা খরচে নিজের সব কিছু ভালো করিয়ে নিতে পারতেন। ঢাকায়ও তাকে ভালোবাসেন অনেকে। তারা চেয়েছেনও হাসপাতালে সব খরচ দিয়ে তার হার্টকে নতুন শক্তি দিতে। তিনি যাননি প্যারিস। শুনেননি কারো কথা। সব ছেড়ে নিজেকে নির্বাসিত করলেন শরিয়তপুরের মতো এক নির্জন জায়গায়। মাঝে মধ্যে কোনো অনুষ্ঠানে ডাকলে দুই- তিন দিনের জন্য আসতেন ঢাকায়।

এবারও তেমনি এসেছিলেন ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র পরিচালক শেখ নিয়ামত আলীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ বাংলাদেশের ‘পথের পাঁচালি’র মতোই আধুনিক সিনেমার মাইল ফলক। এ ছবির দুজন পরিচালকের অন্যজন স্থপতি মসিহউদ্দীন শাকেরের (বুয়েটে স্থপতি হিসেবে আনোয়ার ভাইয়ের দুই বছর সিনিয়র) সঙ্গে তার কথাও হয়েছে অনেকক্ষণ। কারো বাসায় না থেকে হোটেলেই ছিলেন। হয়তো সকালে শরিয়তপুর চলে যেতেন অথচ চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।

বছর দেড়েক আগে শাহবাগ জাদুঘরে স্বনামখ্যাত নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়মের নিজস্ব গ্রæপের অনুষ্ঠানে আনোয়ার ভাইকে তিনি আমন্ত্রিত জানিয়ে ছিলেন। সেবার অনেক দিন পর দেখা হতে বললাম, দু মাস পর টরেন্টো যাওয়ার পথে প্যারিসে সপ্তাহখানেক থামবো ভাবছি, শাহাবুদ্দিন ভাই, শাহাদত আর বন্ধু ভানু (পার্থ প্রতীম মজুমদার) সবার সঙ্গে প্যারিসীয় আড্ডা দিয়ে যাব, আপনি কী থাকবেন তখন প্যারিসে?

তিনি বললেন, আমিতো প্যারিসে থাকি না। আমি বললাম ঢাকায় থাকেন এখন? তিনি বললেন, শরিয়তপুর থাকি এখন। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, ঠিক শুনেছি কি না! তিনি আবার বললেন, কাউকে আসতে বলিও না, তুমি ডলির খুব প্রিয় ছিলে, আমারও তুমি খুব প্রিয়। তাই তোমাকে বললাম, পারলে ঘুরে যেও একবার।

আপনি একা থাকেন, তাহলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা কিভাবে? তিনি রহস্যময় মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, প্রতি সকালে দরজা খুললেই দেখি বাদুড়রা কত ফল দিয়ে যায় আমার জন্য।

একই অনুষ্ঠানে শরিয়তপুরের জেলা প্রশাসকও এসেছিলেন। তিনি আড়ালে আমাকে বললেন যে, তিনি যথাসাধ্য দেখে রাখেন এই বিশ্ব বিখ্যাত আলোকচিত্রীকে। আমার দুইশ গিগার ডিজিটাল ছবির বক্সটি ঢাকায় রয়ে গেছে, এখানে ল্যাপটপে হাতড়ে আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে ছবি পেলাম না। উনি হাজারো ছবি তুলে দিয়েছেন, আমার বিয়ের, মেয়ে হওয়ার পর বছর বছর! এই তো ২০১৩ সালে ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে আমার ছবির প্রদর্শনী ‘কালারস ফ্রম দ্য সোল’-এর পোস্টারের জন্য সারা মুখে রং মাখিয়ে ছবি তুলতে গেলাম ওনার শঙ্করের বাসায়। ইউল্যাব থেকে দেওয়া এই বাসায় বেডসিট, টেবিল ক্লথ সব রং-বেরঙে মাখামাখি। তিনি রাগ করবেন তো দূরের কথা, মগ্ন হয়ে আমার পোট্রেট তুলছেন তো তুলছেন।

১৯৮২ সালে মুক্তধারা থেকে আমার প্রথম গল্পের বই ‘ফিরে যাওয়া’ ব্যাক কাভারের জন্য ছবি তুলে দিয়েছিলেন, মুখ আর ক্যাকটাস মিলিয়ে অপূর্ব সেই ছবি। মুখের পাশে ক্যাকটাসের টবটি হাতে করে তুলে ধরেছিলেন ডলি ভাবী।

৯০ দশকের শুরুর দিকে আনোয়ার ভাই নিজের একটা স্টুডিও করেন কাঁটাবন ফ্যান্সি মাছের দোকান পট্টির বিপরীতে দোতলায়। বিশেষ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থার অনেক ফটোগ্রাফির কাজ ছিল। মডেলিং ছাড়াও কত রকম প্রোডাক্টের কত রকম ছবি! এই স্টুডিওর নাম দেন ‘আয়না’। ডলি ভাবী আর আমি দিনরাত খেটে স্টুডিওর ইন্টেরিয়ার সাজালাম। ওপেনিংয়ের আগে আনোয়ার ভাই ক্যামেরা উঁচিয়ে বললেন, তোমরা দু জন তাকাও! ডলি ভাবী আর আমার এই ছবিটাই ‘আয়না’র প্রথম শট।

প্রিয় আনোয়ার ভাই এবং ডলি ভাবীর কথা এত স্মৃতি-ভালোবাসা মগজে মাছের মতো কিলবিল করছে। ফাঁকে ফাঁকে যতটা পারি লিখব। কেউ পড়–ক আর নাই বা পড়–ক লেখা রইলো!

সৈয়দ ইকবাল: শিল্পী লেখক