বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
 | প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:০৫
লেখকের বাবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়ে পেয়েছিলেন ছাড়খার যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি ভূখ-। সবকিছুই পাকিস্তানি বাহিনী লুটে নিয়ে গেছে অথবা ধ্বংস করেছে। আমেরিকা ও তার বন্ধু রাষ্ট্ররা এই সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মুসলিম বিশ্ব পাকিস্তানের অপপ্রচারের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

তারপরও যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তারা রুখতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার্থে আমেরিকা বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠায়। এই সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকির মুখে মাঝপথে সপ্তম নৌবহরকে থেমে যেতে হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় হয়।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার মুদ্রা চালু করা নিয়ে প্রথমেই সমস্যায় পড়েন। বাংলাদেশ ব্যাংকে নাই অর্থ, স্বর্ণের রিজার্ভ। বিপরীতে সম্পদ না থাকায় সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের টাকা ছাপাতে আপত্তি করে।

দেশে তখনও চলছে পাকিস্তানি মুদ্রা। বঙ্গবন্ধু এমনি এক অসহায় অবস্থার মধ্যে ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশি মুদ্রা চালু করতে বাধ্য হন। এভাবেই শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে মুদ্রার প্রচলন। অন্যদিকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের সব কয়টি বিমান পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে বিমান চালু করার মতো সরকারের কাছে কোনো বিমান ছিল না। ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসকারীদের প্রবাসী বাঙালিদের বাংলাদেশে যাতায়াতের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ কেলেডেনিয়ান এয়ারলাইন্স থেকে বিমান ভাড়া করে চালু করেন বাংলাদেশ বিমান।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পরিচালিত নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে এভাবেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে হলেও সরকার দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

দুই বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যা এসে আঘাত হানে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি আর বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য সারা বিশ্বে সাহায্যের আবেদন করেন। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি আমেরিকা। চালভর্তি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে আটকে রাখা হয়। ফলে খাদ্যের অভাবে মানুষ প্রাণ হারায়। এই সময় ভারতসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে সাহায্য না এলে দুর্ভিক্ষের কারণে আরো অনেক লোকের প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

বঙ্গবন্ধুর পাহাড় পরিমাণ জনপ্রিয়তাকে নিচে নামানোর লক্ষ্যেই এই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধুকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কীভাবে ক্ষমতা থেকে সরানো যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকে।

সর্বশেষ সমস্যা পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন বাঙালি আমলা। এদের নিয়ে প্রশাসন চালানো একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনকে এসব পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন বাঙালি কর্মকর্তা কিছুতেই সহজভাবে গ্রহণ করেনি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

একইভাবে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তান ফেরতদের মধ্যে শুরু হয় বিরোধ। জুনিয়ার অফিসারদের (মুক্তিযোদ্ধা) পদোন্নতি পাকিস্তান ফেরতরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে এখানেও ছিল একটা চাপা দ্বন্দ্ব ও বিদ্রোহের মনোভাব।

এমনি এক সময়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রথমে চালু করেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীকে নতুন করে গঠন করার পরিকল্পনা হাতে নেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি তাদের চক্রান্তে বেছে নিল খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুবুল হক চাষী, নুরুল ইসলাম শিশু ও সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা। অনেকে বলেন, জিয়াও নাকি ছিলেন এদের মধ্যে একজন। কারণ বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান না করায় তিনি ছিলেন মনোক্ষুণœ। তাই ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে আওয়ামী লীগ দাবি করছে।

জিয়া ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না করে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। পরে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও অবলম্বন করেছিলেন একই পথ। ঘরের শত্রু কত ভয়ংকর হতে পারে তার প্রমাণ খন্দকার মোশতাক, কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর গং।

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বৃস্পতিবার বিকালে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন তার নিজের হাতে লাগানো ডাব গাছের চারাগুলোতে পানি দিচ্ছিলেন।

বিষয়টি আমাদের বলেন আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলী মেহেদী খান। তিনি পরে ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে গণভবন থেকে ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দেশীয় এজেন্টদের দ্বারা তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে সেদিন রুখে দেয়। তারপর থেকেই চলতে থাকে ইতিহাস বিকৃতি। এভাবেই একটানা ২১ বছর দেশের প্রজন্মকে তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতে নিয়ে যায়।

সেই কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে এখনো রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। তারেক রহমানের মতো একজন ব্যক্তির নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তারা নতুন করে দেখছে ক্ষমতার স্বপ্ন। দুর্নীতির মাধ্যমে শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়া জিয়া পরিবারকে নিজেদের স্বার্থে স্তম্ভ হিসেবে ধরে রাখতে চায় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি।

এদিকে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও পরে ২০০৮ ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার দেশে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সাফল্য দেখিয়েছে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্ব শান্তিতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সরকারের নেয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ তার বর্তমান অবস্থান থেকে অনেক উপরে উঠে আসবে।

এখন বাংলাদেশ অন্ন, বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৮ কোটি মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়া খুব সহজ বিষয় নয়। এখন প্রয়োজন প্রতিটি মানুষের জন্য বাসস্থান। ইতিমধ্যে সরকার সেদিকে নজরও দিয়েছে।

দেশের সার্বিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এই উন্নতির পেছনে রাখছে বিরাট অবদান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন জীবন দিয়েও হোক তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। তার এই একনিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থ সংগ্রামকে আটকে দেওয়ার জন্য দেশে এখন চলছে নানা ষড়যন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে অনেকেই তাকে তার ব্যক্তিগত বাসভবন ছেড়ে গণভবনে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাকে জেলে নিয়েও মারতে পারেনি। বাঙালিরা আমাকে কখনো মারবে না’।

বাঙালিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কী অগাধ বিশ্বাস! অথচ দেশীয় বাঙালি এজেন্টদের হাতেই বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। আজ আবার নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। দেশীয় এজেন্টদের দ্বারা আক্রমণ আসার আশঙ্কা রয়েছে। যেকোনো সময় তারা আঘাত হানার সুযোগ খুঁজবে। এখানে তারা তাদের এজেন্টদের মালিকানাধীন মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে নতুন ষড়যন্ত্রে সক্রিয় এখন। শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে তারা রুখে দিতে চায়।

তারা চায় না বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর হোক। পদ্মা সেতুসহ দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সহযোগিতার পথকে তারা বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

সুতরাং শেখ হাসিনাকে এখন থেকেই সাবধান হতে হবে। প্রখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার ৮১তম জন্মদিনে বলেছেন, শেখ হাসিনার মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বিরোধী সংগ্রামে তিনি আজীবন সক্রিয় থাকবেন। শ্রদ্ধেয় গাফফার ভাইয়ের মতোই কোটি কোটি বাঙালি রয়েছে শেখ হাসিনার পেছনে। তবুও বলব, সাবধান শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর মতো বাঙালি জাতি চায় না আপনাকে হারাতে। আপনার নেতৃত্বে পথ হারাবে না বাংলাদেশ। আপনি বাংলাদেশের অহঙ্কার। আপনার জয় হোক।

লেখক: সুইডিশ লেফট পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :