সড়কে মৃত্যু: কিছু কথা, কিছু প্রস্তাব

হাফিজ বিন রহমান
 | প্রকাশিত : ১২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৩১

গত বছরের ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক থেকে সড়কপথে ওয়াশিংটন ডিসি যাচ্ছিলাম। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি। পুরো রাস্তায় রোড ডিভাইডার। রাস্তা কল্পনাতীত প্রশস্ত। যানজট ও দুর্ঘটনা নিবারণের জন্য কয়েক কিলোমিটার পরপরই বহির্গমন, তারপরও সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট থেমে নেই। লেন পরিবর্তনের সময় অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে একগাড়ি আরেক গাড়িকে ধাক্কা দেওয়া কিংবা পেছনের গাড়ি সামনের গাড়িকে ধাক্কা দিলে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেই। তখন কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার গাড়ির জট বেঁধে যায়। অথবা জটলা পাকিয়ে যায়। তবে তাদের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সুবিখ্যাত ও সুদক্ষ হওয়ায় অতিদ্রুত সমস্যার সমাধান হয়। কখনো কখনো কয়েক ঘণ্টাও যানজট জেঁকে বসে।

অনেকে হয়তো বলবেন, আমাদের দেশে আমেরিকার উদাহরণ চলে না। আমাদের রাস্তা-ঘাট এতটা প্রশস্ত নয়। আমরা সম্পূর্ণ ডিজিটাল নই ইত্যাদি। সঠিক কথা। কিন্তু আমাদের সারাদেশে যত গাড়ি তার চেয়েতো ওদের দেশে নিউইয়র্ক সিটিতেই অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে।

এবার দুর্ঘটনার কথায় আসি। ওসব দেশে প্রায় সবই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে তো দুর্ঘটনার চেয়ে ঘটনাই বেশি। কারণ ইচ্ছে করে যেটি ঘটানো হয় এটি ঘটনা আর অনিচ্ছায় যা ঘটে তা দুর্ঘটনা (অপপরফবহঃ)। গাড়ির ফিটনেস না থাকা, অদক্ষ হেলপার দ্বারা গাড়ি চালানো, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালানো, অল্পবয়সে গাড়ি চালানো, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেশি যাত্রী পরিবহনের জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে যা ঘটে তা কোনোক্রমেই দুর্ঘটনা নয়; তা অবশ্য ঘটনা (ওহপবফবহঃ). আর ঘটনার কারণে মৃত্যু বা আহত হলেতো কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতেই হবে। তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায় কী? সড়কে দুর্ঘটনা বা ঘটনা যাই-ই ঘটুক ফলাফল নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। এর থেকে বাঁচার জন্য কয়েকটি বিষয় মানা প্রয়োজন।

এক. ট্রাফিক সিগন্যাল মান্য করা

প্রতিবেশী ভারতের কলকাতাতেও ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে গাড়ি চালানো হয়। এতে যেমন জাতি হিসেবে মর্যাদা সমুন্নত হয় তেমনি যানজট অনেকাংশে হ্রাস পায়। আইনের নিরপেক্ষ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। বিতর্কের জন্য অনেকেই বলেন, ঢাকা এত জনবহুল যে ট্রাফিক সিগন্যাল মানা কঠিন। এতে যানজট বাড়বে। আসল বিষয় সেটি নয়। বিষয় হচ্ছে আমাদের অনুশীলন নাই। আমরা ট্রাফিক আইন মেনে চলাতে অভ্যস্থ নই। আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত নই। কারোরই সদিচ্ছা নেই। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ঢুকলে ট্রাফিক আইন মেনে চলি। সিগন্যাল মেনে চলি। পুরাদস্তুর সুনাগরিক। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার পরই আবার আমাদের পাখনা গজায়। সত্যি সত্যিই যদি যানবাহনের সংখ্যাধিক্যের কারণে ট্রাফিক সিগন্যাল মানা কষ্টকর হয়, তাহলে প্রতি শুক্র ও শনিবার ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে জনগণকে বাধ্য করা যায়। ধাপে ধাপে অনুশীলন করে সিগন্যাল বাতির মাধ্যমে আমরা পথ চলতে পারি। এ ক্ষেত্রে অনুশীলনের জন্য প্রথম পর্যায়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বৃহত্তম জেলাগুলোতে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য জেলাতে সিগন্যাল বাতির নির্দেশনা মতো পথ চলতে বাধ্য করা যায়। কারণ রাজধানী ঢাকা শহরে যেসব মানুষের আসা-যাওয়া চলে তাদের অধিকাংশই দেশের অন্যান্য শহর থেকে এসে থাকে। সুতরাং ঢাকার বাইরের নাগরিক সুনাগরিক হলেই ঢাকাতেও এক সময় সুনাগরিক ভিড় জমাবে।

দুই. জনসচেতনতা

জনগণকে সচেতন করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন: ট্রাফিক আইন সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে সিলেবাসভিত্তিক পাঠদান। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট নামক বিস্তৃত বিষয়ে পাস না করলে ট্রাফিক পুলিশ ও এদতসংশ্লিষ্ট পেশায় পদোন্নতি প্রদান না করা। নাটকে, সিনেমা, ডকুড্রামা, বিজ্ঞাপন, টিভি ফিলার ইত্যাদি তৈরির সময়ে নির্মাতারা সিগন্যাল বাতি ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টকে গঠনমূলকভাবে তুলে ধরতে পারেন। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে জেব্রা ক্রসিং করে তার সুষ্ঠু ব্যবহার সুনিশ্চিত করা।

তিন. আইনের কঠোর প্রয়োগ

ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ সুষম, বাস্তবানুগ ও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। দলমত শ্রেণি নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই যানজট ও সড়ক দুঘর্টনা কমানো সম্ভব।

চার. অবৈধ স্থাপনা ও যত্রতত্র পার্কিং

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাস্তাঘাট দখলমুক্ত করা প্রয়োজন। রাস্তার পাশে ইট, বালু, পাথর, সিমেন্ট, কাঠ ও দোকান-পাট করে যারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তাদের ব্যাপারে সঠিক বিচার নিশ্চিত করা। ঢাকা শহরে ও বিভিন্ন রাস্তায় ভ্যান, রিকশা, সিএনজি, ব্যক্তিগত গাড়ি, স্বল্প ও দূরপাল্লার গাড়ি পার্কিং করা হয় এদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেই যানজট অনেকাংশে কমে আসবে।

পাঁচ. প্রযুক্তির সহায়তা

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিকে আধুনিকীকরণ করে রাস্তায় স্পিডোমিটার ও সিসি ক্যামেরা বসানো প্রয়োজন। কেউ বেপরোয়া গাড়ি চালালে কিংবা সিগন্যাল বাতির নির্দেশনা উপেক্ষা করে কোনো গাড়ি চললেই ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তুলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রমও মনিটরিং করা সম্ভব হবে।

(((পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের জন্য। সেই মানুষ যদি বিনা কারণে মরে যায়, তাহলে অন্য কোনো সিস্টেমতো আর চলার প্রয়োজন নেই। তাই মানবকল্যাণে সড়ককে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন আইন, সড়ক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন। মানুষের নির্দেশ নয়; মেশিনের নির্দেশে পথ চলা। সুদক্ষ সড়ক শ্রমিক গড়ে তোলা। তবেই যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা কমবে; মৃত্যুর মিছিল থামবে।))))

লেখক: বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :