বধ্যভূমি থেকে বেঁচে ফেরা রবিউলের গল্প

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৭:৫৬

কাজী রফিক

রবিউল আলম। ১৯৭১ সালে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বয়স ছিল ১৪ বছর। আর এলাকায় ঘুরতে গিয়ে ধরা পড়েন আলবদর ও রাজাকারদের কাছে। কিন্তু ঘটনাচক্রে বেঁচে ফেরেন।

এই রায়েরবাজারেই বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বারবার ছুটে আসেন রবিউল। তার আবেগটা একটু বেশি এ কারণেই যে, তিনি যা দেখেছেন, সেটা দেখেননি অন্য কেউ। খুনিদের প্রতি ঘৃণাটাও বেশি তার।

গতকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিসৌধে দেখা হলো ৬১ বছর বয়সী এই মানুষটির সঙ্গে। করেন ৪৭ বছর আগের স্মৃতিচারণা।

রবিউলকে গুলিও করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি গায়ে লাগেনি। পরে এক রাজাকারের দয়া হলে ছেড়ে দেওয়া হয়। বেঁচে যান।

কেন বধ্যভূমিতে গিয়েছিলেন?

যুদ্ধের সময় খাবারের সংকট। সকালের খাবারের ব্যবস্থা করতে কয়েকজন কিশোর মিলে বের হন মাছ ধরতে। তখন এই এলাকাটা জলায় পরিপূর্ণ। মাছে ভরপুর।

পাশের একটি ইটভাটা দেখিয়ে রবিউল বলেন, ‘স্মৃতিসৌধটা যেখানে স্থাপন করা হয়েছে, তার রাস্তার বিপরীতে মূলত বধ্যভূমি ছিল। সেই জায়াগাটাতেই শত শত লাশ ফেলে রাখা হয়। আমরা যখন মাছ ধরতে ধরতে এই জায়গায় আসি, তখন এখানে আমরা দেখতে পাই অনেক বিকৃত চেহারার লাশ পড়ে আছে।’

‘মানুষের গলিত লাশ এবং বিভিন্নভাবে লাশ পড়ে থাকার দৃশ্য দেখে আমি চিৎকার দিই। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা ছুটে আসে। তারা ভাবে যে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেছে।’

‘রাজাকাররা আমাদের ওপর মেশিনগানের গুলি করে। আমরা মাটিতে শুয়ে পড়ি। কিন্তু অলৌকিকভাবে আমি বেঁচে যাই।’

তবে বেঁচে গেলেও রবিউল নিরাপদে ফিরতে পারেননি। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রাজাকারের ক্যাম্পে। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল সেখানেও।

‘বাড়ি যাওয়ার পরে আবার বাড়ি থেকে ধরে এনে আবদুল হাইয়ের বাড়িতে রাখে। রাতের আঁধারে আমাদেরকে নিয়ে আসে। আমার বয়স একটু কম থাকা জমির সার্জেন্ট নামের এক রাজাকার আমাকে মুক্তি দেয়। আমি এখনো বেঁচে আছি। এই রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একমাত্র জীবিত ফেরত।’

মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষে বিজয়ের ঊষালগ্নে হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। সব মিলিয়ে নয় শর বেশি। এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ১৪ ডিসেম্বর। জড়িত ছিল জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনী।

এই বাহিনীর শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের পর বিচারের দাবি আর বড় হয়ে উঠছে না। পাকিস্তানিদের দোসরদের উত্তরসূরিদের প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানানো হয়েছে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার এই আয়োজনে।

রবিউল বলেন, ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবীসহ শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়। গলিত, অর্ধগলিত, চেহারা নষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক লাশই চিনতে পারেনি শহীদদের স্বজনরা।

‘১৬ ডিসেম্বর এখান থেকে নিজ হাতে অনেক লাশ তুলে দিয়েছিলাম। ইটের পটের ভেতরে শত শত লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ১৭ ডিসেম্বর সেগুলো শিয়াল-কুকুরে টেনে বের করেছে। বর্তমান বেড়িবাঁধের বিপরীতে যে জায়গাটা, সেখানেও অনেক লাশ ছিল।’

‘আমার বাড়ি সেহেতু পাশে, লাশ উদ্ধারের সময় আমি এখানে এসে দাঁড়াই। একজন মা তার সন্তানকে খুঁজছিলেন। একটা লাশ অনেক সময় ধরে টানছিলেন, কিন্তু তুলতে পারছিলেন না। আমার মায়া লাগে। আমি নিজে গিয়ে লাশ তুলতে সাহায্য করি। লাশ তোলার সময় আমি কাদায় পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার পর সকাল থেকে সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত লাশ তুলেছি আর স্বজনদের হাতে তুলে দিয়েছি।’

রবিউল বলেন, ‘এক মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এটা কি আপনার ছেলের লাশ? সেই মা বলেছিলেন, হয়তো হবে, হয়তো নাও হতে পারে। তবে আমি একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে সমাধিত করতে পারব এটাই আমার সান্ত¡না।’