বাংলাদেশ নিয়ে ধন্দ কাটে না পাকিস্তানের

প্রকাশ | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:০৬

নজরুল ইসলাম

বাঙালি কালো, খাটো, সাহসী নয়। এরা মাছ খায়, তাও আবার হাত দিয়েÑআরও কত কী বলে কটাক্ষ করত। এখন সেই পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মতো হতে চায়। কীভাবে বাংলাদেশ তাদের উন্নয়নের প্রায় সব সূচকে ছাড়িয়ে গেল, ধন্দ কাটে না তাদের।

এই সেদিন দেশটিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে পাকিস্তানকে সুইডেন বানানোর কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। টেলিভিশন টক শোতে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জাইঘাম খান বলেন, ‘খোদা কি ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো, পাঁচ সাল নেহি, ১০ সালছে।’

ইমরান খান কী ভাবছেন? এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘আমি এমনও শুনেছি, পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছে তো ভালো হয়েছে। কিন্তু আজ তারা সবকিছুতে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে।’

পাকিস্তানের কবল থেকে বাঙালির আলাদা হওয়ার সংগ্রামের নেপথ্যে ছিল বৈষম্য। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া। অর্থনীতির আকার যাও ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসযজ্ঞে ক্ষতি হয়েছে সেটারও। বলা হচ্ছিল, পৃথিবীর দারিদ্র্যের উদাহরণ হবে বাংলাদেশ। পাকিস্তানিরা যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ে প্রবোধ গুনত এ নিয়ে।

কিন্তু হেরে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। গত ৪৭ বছরে উন্নয়নের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখন পাকিস্তানিদের কাছে উদাহরণ হয়ে গেছে বাংলাদেশ। তাদের টেলিভিশন টক শোতে মার্চ আর ডিসেম্বরে নিয়মিত আলোচনা হয় বিষয়গুলো নিয়ে।

মাথাপিছু আয়, মাথাপিছু উৎপাদন, শিল্পোন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানুষের গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্কুলে পাঠগ্রহণ, সরকারের স্থিতিশীলতা, জ্বালানির ব্যবহার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ উন্নয়নের বহু সূচকে এখন পিছিয়ে পাকিস্তান।

২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন প্রবৃদ্ধিতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়, তখন তাকে দুর্ঘটনা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু পরের বছরগুলোতে তাদের পিছিয়ে পড়া আরও নিশ্চিত হতে থাকে। বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছে, পাকিস্তান তাল মেলাতে পারছে না তার সঙ্গে।

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে উদাহরণ হয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পর দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাবে এটা ২২.৪ শতাংশ। এই দিক থেকে পাকিস্তান এখন যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছে। সে দেশের প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে এখন ৪০ জনই দরিদ্র।

জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ থেকে আট ধাপ পেছনে পাকিস্তান। বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ১৩৯তম, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান ১৪৭তম।

মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের দিক দিয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ এক হাজার ৭৫১ ডলার, পাকিস্তানে সেই জিডিপি এক হাজার ৪৭০ ডলার।

মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এখন এক হাজার ৩৮০ ডলার। সেখানে বাংলাদেশের এক হাজার ৭৫১ ডলার।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা পাকিস্তান থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বেশি।

বাংলাদেশে মোট জাতীয় আয়ের বিপরীতে সঞ্চয়ের হার ২৬ শতাংশ। পাকিস্তানে এটি ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উদাহরণ পাকিস্তানের জন্য। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম অংশের চেয়ে বেশি ছিল। এখন পরিস্থিতি উল্টো। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। কিন্তু পাকিস্তানের প্রায় ২০ কোটি।

দুই বছর আগের হিসাবে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭, পাকিস্তানে এটা ২.২। বাংলাদেশে মা-প্রতি সন্তানের গড় সংখ্যা ২.১৪। কিন্তু পাকিস্তানে এই সংখ্যা ৩.৫৫।

পোশাক রপ্তানির দিক থেকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। বিশ্বে মোট পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ এখন ৬.৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে যতটুকু পোশাক দরকার পড়ে, তার ৬.৫ শতাংশ আসে বাংলাদেশ থেকে। ২০১৭ সালে পোশাক খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৮.১৩ বিলিয়ন ডলার। সেখানে পাকিস্তানের আয় ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের পোশাক খাতের আয়ের অর্ধেকেরও কম।

বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মধ্যে ৪৪ জন কোনো না কোনো পেশায় যুক্ত। পাকিস্তানে এই সংখ্যাটা ২৫ মাত্র।

বাংলাদেশের একজন নারী বছরে গড়ে আয় করেন এক লাখ ৯২ হাজার ৬৯৯ টাকা। সেখানে পাকিস্তানের একজন নারীর আয় এক লাখ ২১ হাজার ৩৩৮ টাকা।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ছয় বছর বেশি বাঁচে, যেটা স্বাস্থ্য খাতেও এগিয়ে থাকার প্রমাণ। পাকিস্তানিদের গড় আয়ু যেখানে ৬৬ বছর, সেখানে বাংলাদেশের এটি ৭২ বছর।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে যত শিশু জন্ম নেয় এবং পাঁচ বছর বয়স হওয়ার পর ৯৭ শতাংশ শিশুই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বা উপযোগী থাকে। পাকিস্তানে এই হার ৯৩ শতাংশ।

বাংলাদেশের একটি শিশু চার বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করে ১৮ বছর পার হওয়ার আগে গড়ে ১১ বছর শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানের শিশুরা ৮.৮ বছর স্কুলশিক্ষা পায়।

১০০ বাংলাদেশি শিশুর মধ্যে ৬৪ জন যথাযথ উচ্চতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। পাকিস্তানে এটি ৫৫ জন।

পাকিস্তানে শতকরা ১৭ শতাংশ সদ্যোজাত শিশু ডিপিটি টিকা থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে এই সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ। পাকিস্তানে হামের টিকা থেকে বঞ্চিত হয় শতকরা ২৪ শতাংশ শিশু। বাংলাদেশে এই সংখ্যা মাত্র ছয়জন।

জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (জিডিআই) সূচকও পাকিস্তানের ঈর্ষার কারণ। বাংলাদেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৮৮১। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের স্কোর শূন্য দশমিক ৭৫০।

সাক্ষরতার হারেও বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশে এই হার যেখানে শতকরা ৭২ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানে পড়তে জানে না ৪১ শতাংশ।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান মান বিবেচনা করলে বাংলাদেশের শিশুরা পাকিস্তানের শিশুদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল হবে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এই সূচক অনুযায়ী, ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম। পাকিস্তান ১৩৪তম।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পাকিস্তান পিছিয়ে। বাংলাদেশ মাথাপিছু ০.৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। পাকিস্তানে এটা ০.৯ টন। বায়ুদূষণের প্রভাবে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৪৯ জন, পাকিস্তানে যা ১৭৩ দশমিক ৬ জন। দূষিত পানি ও পয়োনিষ্কাশন অব্যবস্থাপনার কারণে পাকিস্তানে ১৯ দশমিক ৬ জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে এই হার ১১ দশমিক ৯ জন।

পাকিস্তানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে এই সংখ্যাটা যেখানে ৭১, সেখানে পাকিস্তানে এই সংখ্যা দুই হাজার ৭৪২ জন বেশি।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকেও পাকিস্তান পিছিয়ে। দেশটিতে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। দেশটির সরকারের ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখনো নানা সমালোচনা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৬ বছরের সামরিক শাসনের জঞ্জাল পেরিয়ে এখন একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারটি সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ পূরণ করেছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথাও তুলতে হয়। জঙ্গিবাদের থাবায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই হয় রক্তাক্ত হামলা। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে প্রতি লাখে হত্যার শিকার হয় ২.৫ জন। আর পাকিস্তানে এই সংখ্যা ৪.৪।