টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
 | প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৫০

১৪ প্রতিশ্রুতি ও ৩৫টি অঙ্গীকার করে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে বিএনপির নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যেখানে বলা হয়েছে, টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না। তবে এই বিধানের ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য হবেন কি না, এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে গতকাল ইশতেহার ঘোষণা করে ঐক্যফ্রন্ট। এখানে বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলা হয়।

সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে ঐক্যফ্রন্টের এই ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জোটের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন। পরে ইশতেহার পড়ে শোনান মাহমুদুর রহমান মান্না।

যদিও এসব প্রতিশ্রুতির কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আর সাংবাদিকদের একটির বাইরে প্রশ্ন করার সুযোগও দেননি ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। ফলে অনেক বিষয়ে রয়ে যায় ধোঁয়াশা।

ক্ষমতার ভারসাম্য

যে ১৪টি প্রতিশ্রুতি রয়েছে তার তিন নম্বরে উল্লেখ আছে ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা। এখানে নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান তৈরি, নির্বাচন কমিশনকে পুর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেওয়া, মুক্তভাবে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিতের কথা বলা আছে। তবে এতদিন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের যে দাবি করে আসছিলেন তারা, সেটির বিষয়ে বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু নেই। আর নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তার কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি।

সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিষয়ে থাকা ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, একটানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান, সব দলে ন্যূনতম ২০ শতাংশ নারী প্রার্থী দেওয়া, প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা পরীক্ষার জন্য সর্বদলীয় জাতীয় কমিশন করার কথা বলা আছে।

ক্ষমতায় গেলে টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না বলে আইন করা হবে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঐকফ্রন্ট নেতা সুব্রত চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে এই বিষয়ে অবশ্যই আইন করব।’

তাহলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না- এই মন্তব্যের জবাবে সুব্রত বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি পারবেন না। কারণ, তিনি পরপর দুইবারের প্রধানমন্ত্রী।’

তাহলে তো বেগম খালেদা জিয়াও আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারছেন না- এই মন্তব্যের বিপরীতে অবশ্য ঘুরে যায় সুব্রতর বক্তব্য। বলেন, ‘না, না তিনি পারবেন। আপনি বিষয়টা বুঝতে পারছেন না। তিনি তো পরপর দুই বারের প্রধানমন্ত্রী নন।’

তবে খালেদা জিয়া পরপর দুই বারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৯১ সালের পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠন করে। তবে ১২ কার্যদিবস চলার পর খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। তাহলে তিনি কীভাবে আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন?- এ বিষয়ে জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন সুব্রত।

একই বিষয়ে জানতে ঐক্যফ্রন্ট নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তাকে ফোন করা হলে প্রসঙ্গ শুনেই তিনি ফোন কেটে দেন।

‘জিঘাংসা নয়, জাতীয় ঐক্য’

ইশতেহারের শুরুতেই এই শিরোনামে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা, গুম, খুন, মামলার ঘুষ বাণিজ্য ও বিচারবহির্ভুত হত্যায় লক্ষ পরিবার ক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত। এই সমস্যা সমাধান করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, আইনজীবী সমন্বিত সর্বদলীয় সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন গঠন করা হবে। হয়রানি মামলা সুরাহার লক্ষ্যে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে।

সব জাতীয় বীরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করে স্কুল, কলেজে পড়ানো এবং বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করা হবে। একদলীয় শাসনের যেন পুনঃজন্ম না ঘটে তা নিশ্চিত করা হবে।

নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম পুরোপুরি বন্ধ, ডিজিটাল নিরাপ্তা আইন বাতিল, রিমান্ডের নামে শারীরিক নির্যাতন বন্ধ, সাদা পোশাকে গ্রেপ্তার না করার কথাও বলা আছে।

নারীর ওপর যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানো এবং যৌতুক পুরোপুরি বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছে।

সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে। অঙ্গীকার করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালু রাখার বিষয়ে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে থাকবে বলেও অঙ্গীকার করেছে ঐক্যফ্রন্ট। পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বাজেট স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় হবে।

জেলা পরিষদ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। ভবিষ্যতে সিটি করপোরেশনে চালু হবে নগর সরকার।

দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন

বর্তমান সরকারের আমলে ‘দুর্নীতির’ তদন্ত করে জড়িতদের বিচার, ন্যায়পাল ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া, সরকারি চাকুরেদের গ্রেপ্তারে অনুমতির বিধান বাতিল, অর্থপাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং পাচার করা অর্থ ফেরতের কথাও বলা হয়।

চলমান কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না জানিয়ে শেষ দুই বছরে ‘তড়িঘড়ি করে’ নেওয়া প্রকল্প পুনর্বিবেচনার জন্য কমিটি, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয় নিরীক্ষার উদ্যোগও নেবে ঐক্যফ্রন্ট।

ব্যাংকি খাতে ‘লুটপাটে’ জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া, ‘সরকারি মদদে’ শেয়ারবাজারে লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার অঙ্গীকারও আছে।

কর্মসংস্থান এবং শিক্ষা

পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা তুলে দেওয়া, শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রাখার কথাও বলা আছে।

ত্রিশোর্ধ শিক্ষিত বেকারদের জন্য বেকার ভাতা চালুর জন্য কমিশন করা, তিন বছরের মধ্যে সব সরকারি শূন্যপদে নিয়োগ, ওয়ার্ক পারমিটবিহীন বিদেশিদের চাকরি বন্ধ করা হবে।

পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করা ও মোবাইল ইন্টারনেট খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথাও জানানো হয়।

স্বাস্থ্যখাত

৩১ শয্যার উপজেলা হাসপাতালকে ৫০ শয্যা করা, সব জেলায় ২০ শয্যা সিসিইউ ও আইসিইউ, ১০ শয্যার এনআইসিইউ স্থাপন, পুরাতন ২১ জেলায় অগ্রাধিকারভিত্তিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার ও একটি করে ক্যান্সার কেমোথেরাপি সেন্টার গড়া হবে। তিন মাসের মধ্যে ওষুধ ওরোগ পরীক্ষার খরচও কমানো হবে।

জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন

দুই বছরের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি ১২ হাজার টাকা করা, শিল্পএলাকায় শ্রমিকদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ এবং সব খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হবে।

কৃষিতে উৎপাদন খরচের সঙ্গে মুনাফা নিশ্চিত করে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ, দরিদ্রদের জন্য সুলভ মূল্যে রেশনিং চালুর কথাও বলা আছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

প্রথম বছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে না। সর্বোচ্চ ১০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের দাম পাঁচ বছরেও বাড়বে না। গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং হাসপাতালে হ্রাসকৃত দামে বিদ্যুত সরবরাহ করা হবে। অন্যান্য প্রতিশ্রুতি

প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীকর্মীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মরদেহ আনা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত বিচার, যানজট নিরসনে ‘জরুরি পদক্ষেপ’ নেওয়া, শহরের গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবহননীতি প্রণয়ন, রেলখাতকে ‘অত্যন্ত’ গুরুত্ব ও সম্প্রসারণ; প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র কেনা, পুলিশ বাহিনীর ঝুঁকিভাতা বাড়ানো, পুলিশের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ; সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়-নীতিতে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত করার পদক্ষেপ নেওয়া; তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা হবে; জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব রোধে আরো বেশি আন্তর্জাতিক সাহায্য নিশ্চিতের কথাও বলা হয়েছে ইশতেহারে।

‘রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন’

কামাল হোসেন বলেন, ‘এই রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের মেরামত করে প্রতিহিংসা দূর করে জনগণের ঐক্য তৈরি করা। অনেকে এই ঐক্যের বিরুদ্ধে মানুষ লাগিয়ে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।’

ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে ‘বৈপ্লবিক ইশতেহার’ বলে অভিহিত করেছেন। বলেন, ‘জনগণের যে মৌলিক দাবি-দাওয়া গুলো রয়েছে তা এ ইশতেহারের মাধ্যমে উঠে এসেছে। মানুষের আশা-আকাঙ্খাগুলো এর মধ্যে এসেছে। এটি সাম্প্রতিককালের একটি বৈপ্লবিক ইশতেহার হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

জঙ্গিবাদ কোনো বিষয় নয়: জাফরুল্লাহ

অনুষ্ঠানে একটিমাত্র প্রশ্ন নেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। একজন গণমাধ্যমকর্মী জানতে চান, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই কেন। জবাবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মানুষ মেরে পৃথিবীর কোনো দেশে জঙ্গিবাদ নিরসন হয়নি, মাদকও নিরসন হয়নি। এ সরকার মাদক নিরসনের কথা বলে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করছে। মানুষ হত্যা কোনো চিকিৎসা নয়। আপনারা সুষ্ঠু নির্বাচন দেন, তাহলে দেখবেন সব সমস্যা অতি সহজে সমাধান হয়ে যাবে। জনগণ শান্তি চায়, জনগণ কল্যাণকর বাংলাদেশ চায়।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :