ইশতেহারে রাজধানী ঢাকার চালচিত্র

তায়েব মিল্লাত হোসেন
 | প্রকাশিত : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:১২

বাড্ডা, রামপুরা আর ভাটারা- এ তিন এলাকা মিলিয়ে সংসদে রাজধানীর একটি নির্বাচনি আসন ঢাকা-১১। এখানে রামপুরা এখন থানা। বাড্ডা ও ভাটারাও থানা। আবার ইউনিয়ন পরিষদও। হালে এ দুই ইউনিয়ন বিলুপ্তির উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন আছে। দুটিই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে যুক্ত হতে চলেছে। সব চূড়ান্ত। শুধু কার্যক্রম এখনো বাকি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জটিলতার কারণে বিষয়টি ঝুলে আছে। এর মাঝেই চলে এসেছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাড্ডা-ভাটারার সব গ্রাম শহর হবে, ভোটের প্রচারপত্রে তা সামনে নিয়ে এসেছেন ঢাকা-১১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য একেএম রহমতউল্লাহ।

কিছু গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন হয়। বাড্ডা-ভাটারায় গ্রাম এখনো আছে বটে। তবে তার অনেকই গ্রামের চরিত্র হারিয়েছে। পড়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের কবলে। প্রশাসন গ্রামের। অথচ চরিত্র নগরের। এতে অবশ্য শৃঙ্খলার বড় অভাব। নাগরিকগণ শহরের সেবা থেকে বঞ্চিত। মহানগরের গ্রাম বলে অসরকারি সেবাদানকারীরাও সেভাবে সক্রিয় নয়। সবটা মিলে প্রদীপের নিচে অন্ধকার!

পুরো ঢাকার আঁধার কাটাতে হবে। মহানগর, মেগাসিটি, মেট্রোপলিটন, কসমোপলিটন- এই শহরের এসব অভিধা সার্থক করতে হলে নগরকে প্রকৃতই তিলোত্তমা রূপে গড়ে নিতে হবে। তার প্রতিধ্বনি কতটা আছে একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সদ্যই ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে? ঢাকা নগর নিয়ে তারা আসলে কতটা ভাবছে? সে ভাবনায় নগরবিদদের অংশগ্রহণ কতটা ছিল? প্রশ্নগুলো সহজ, তবু উত্তর জানতে চাইবো না আমরা। বরং যারাই সরকারে আসবে তারা ঢাকা শহরের সব নৈরাজ্য, সব সংকট দূর করবে- এটাই চেয়ে যাব, এই আশা নিয়ে বসে থাকব।

এবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহারে হালের দুই মেয়াদের অর্জনের কথা রয়েছে। সেই হিসেবে তারা বলেছে নন্দনে আর বিনোদনদানে অনন্য স্থান হাতিরঝিলের কথা। কেননা তাদের আমলে এটা বাস্তব রূপ পেয়েছে। আর সামনের দিনে দেশের সব শহরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও যাতায়াত খাত উন্নত করার অঙ্গীকার করেছে। নাগরিক সেবা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই তালিকায় ঢাকা শহরও আছে, এটাই চাইবো আমরা। একই হিসেবে চলতি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের যে কথা আছে, তার বরাতেই ঢাকার মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে- এগুলো সফল বাস্তবায়ন চাইবো সামনের দিনগুলোয়।

অঙ্গীকারনামায় তারা অবশ্য বলেছে, ‘মেট্রোরেল স্থাপনের কাজ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ডিসেম্বর ২০১৯ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ডিসেম্বর ২০২০ সালে শেষ হবে।’

নগর নিয়ে আওয়ামী লীগের আরো ভাবনা হচ্ছে- ‘নগর ও শহরে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং নগর ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।’ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ, রাজউক, ডিপিডিসি, ডেসকো, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস- আপনারা এই অঙ্গীকার নিয়ে কিছু ভাবছেন?

সরকারি দলটির ইশতেহারে এবার বেশ গুরুত্ব পেয়েছে ‘আমার গ্রাম- আমার শহর’ শীর্ষক রূপরেখা। যেখানে ‘প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ’-এর কথা বলা হয়েছে। এটা হলে অবশ্যই ঢাকামুখিনতার চাপ কমবে। আর রাজধানীর জনস্রোত না থামানো পর্যন্ত যত কিছুই করা হোক না কেন, শহর ঢাকা শৃঙ্খলায় ফিরতে পারবে না কোনোদিনই। এই বেলায় আরো দুটি বিষয় বলে রাখতে চাই-

এক. ঢাকা বা ঢাকার কাছাকাছি বিমানবন্দরের মতো আর কোনো বড় প্রকল্প না করাই উত্তম। কেননা এমনটি হলে ঘুরেফিরে জনঘনত্ব ঢাকায় বাড়তে থাকবে।

দুই. গ্রামবাসীকে নিঃসন্দেহে শহরের সেবা দিতে হবে। তাই বলে সব কৃষিজমি, ডোবানালা, মাঠঘাট, পুকুরডোবা, বিলঝিল, নদনদী মিলিয়ে দিয়ে দালানপাট, বিপণিবিতান করতে হবে; এর কোনো মানে হয় না। কারণ আমাদের জীবনের জন্য ভাত-মাছ, জল-বাতাস আরো বেশি প্রয়োজন। তাই গ্রামকে গ্রাম রেখে, খাদ্যশস্য, পানি-বায়ুর জোগান ঠিক রেখে সব কিছু করতে হবে। আজকে বিষাক্ত বাতাসের, পানিবন্দি সময়ের ঢাকায় আমরা যে ভুলগুলো উপলব্ধিতে আনি, সেগুলো আর কোথাও না বাড়াই।

ঢাকা শহরের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে যেসব প্রকল্প এখন চলছে, পরের মেয়াদে সরকারে আসতে পারলে সেগুলো শেষ করার অঙ্গীকার করছে আওয়ামী লীগ। এর সঙ্গে তাদের যেসব প্রস্তাবিত প্রকল্প চমক দিতে পারে, তার মধ্যে আছে- ‘ঢাকাকে ঘিরে একটি এলিভেটেড রিংরোড এবং ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণেরও পরিকল্পনা’, ‘মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে যাতে চট্টগ্রামে পৌঁছানো যায় সেজন্য বুলেট ট্রেন (দ্রুতগামী ট্রেন)’, ‘পাতাল রেল’ এবং ‘সার্কুলার রেলপথ’।

প্রায় এক যুগ রাষ্ট্র পরিচালনায় নেই দেশের আরেক প্রধান দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তাদের ইশতেহারে ঢাকা শহর নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো কথা নেই। নগরায়ন নিয়েও তেমন কিছু বলেনি তারা। তবে বলেছে, ‘দেশে আঞ্চলিক ও শ্রেণি বৈষম্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।’ বিষয়টা ‘ভয়ংকর’ হতে পারে না। কিন্তু আংশিক হলেও সত্য। সব কিছুতে ঢাকাকেন্দ্রিকতাই তার লক্ষণ। অতীতে একাধিকবার ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপি এ বিষয়ে কোনো সুরাহা দেয়নি। সামনে আসতে পারলে কী করবে, তা-ও বলেনি।

পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে দলটির প্রস্তাব, ‘সড়ক পথে চলাচলে বিরাজমান বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটানো হবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এখানে ঢাকাও আছে এটাই ধরে নিলাম আমরা। তবে কীভাবে কী করবে, এখানে তার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা দেয়া হয়নি।

বিএনপি ইশতেহারে বলেছে, ‘দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে।’ ঢাকার দুই মেয়র এমন ক্ষমতা পাবেন, এটা দেখতে চাই আমরা। কারণ কোথাও প্রকল্প মালিক রাজউক, কোথাও স্থানীয় সরকার, কোথাও গণপূর্ত, কোথাও সড়ক বিভাগ- ঢাকা শহরে এমন বিক্ষিপ্ত উন্নয়ন দেখতে চাই না আমরা।

বিএনপি বলছে, ‘বর্তমানে কমবেশি ৫% বাজেট স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করার পরিবর্তে প্রতিবছর ৫% হারে বাড়িয়ে ৫ বছরে কমপক্ষে ৩০% বাজেট স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করার বিধান করা হবে।’ এমন প্রস্তাব তো ঢাকার মেয়র ও কাউন্সিলরদের প্রশংসা কুড়াবে, এটা নিশ্চিত।

দলটির আরো এক অঙ্গীকার হচ্ছে: ‘পৌর এলাকাগুলোতে সব সেবা সংস্থা মেয়রের অধীনে রেখে সিটি গভর্নমেন্ট চালু করা হবে।’ বিষয়টি কী ঢাকার জন্যও প্রযোজ্য? অবিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ সেই আড়াই-তিন দশক আগে নগর সরকারের কথা বলেছিলেন। আমরা আজও তার স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছি। কবে আর হবে নগর সরকার?

বিএনপির প্রস্তাবে ঢাকা নিয়ে কিছু নেই। একজন ঢাকাপ্রেমী হিসেবে বিষয়টি বড় বেদনার মনে হচ্ছে। এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) ইশতেহারেও একই বেদনা রয়েছে। তবে মাত্রা একটু কম। কেননা একমাত্র তারাই ঢাকার আদি নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ চয়ন করেছে। তাদের ইশতেহারের ১৮ দফা কর্মসূচির প্রথম দফায়ই বলা হয়েছে, “দেশের এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। দেশে বিদ্যমান ৮টি বিভাগকে ৮টি প্রদেশে উন্নীত করা হবে। ৮টি প্রদেশের নাম হবে (১) উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, (২) বরেন্দ্র প্রদেশ, (৩) জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, (৪) জালালাবাদ প্রদেশ, (৫) জাহানাবাদ প্রদেশ, (৬) চন্দ্রদীপ প্রদেশ, (৭) ময়নামতি প্রদেশ এবং (৮) চট্টলা প্রদেশ।”

সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘ঢাকা শহর থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদর দপ্তর প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থানান্তর করা হবে।’ প্রস্তাব মন্দ নয়। কিন্তু মোগলদের সুবিশাল সুবা বাংলার অনেকটাই ভাগ হয়ে একটা অংশ নিয়ে হয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে পুরো দেশ ভাগ করে প্রদেশ কতটা বাস্তবসম্মত? জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরাই আমার চেয়ে বিষয়টি নিয়ে ভালো বলতে পারবেন।

তবে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ আমরা চাই নানা দিক দিয়ে। চাই পুরো দেশের সহজ যোগাযোগ অবকাঠামো। পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন তা নিশ্চিত করবে অনেকখানি। কমাতে পারে ঢাকার চাপও। আবার বাড়ানোর ঝুঁকিও থেকে যাবে, যদি না আরো আরো বিকল্প নগর, আরো আরো বিকল্প স্থানে কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হয়। ‘চাচা, ঢাকা কত দূর?’- এই হাঁকডাক, এই হাতছানি কমিয়ে আনতে হবে। আনতেই হবে।

আরো একটা বিষয় মনে পড়ে গেল। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকা বা বৃহত্তর যে ঢাকা তার আন্তঃযোগাযোগের সহজ কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। একটু উদ্যোগী হলেই কম খরচেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ একটি স্থলপথ সহজেই তৈরি হতে পারে। কিন্তু সবই প্রস্তুত, কেবল পেরেক ঠোকার কেউ নেই- অবস্থা এমন। এবার নির্বাচনে প্রচারে অবস্থা বুঝেছেন, ঢাকা জেলার দুই উপজেলা দোহার ও নবাবগঞ্জের (ঢাকা-১ আসন) একজন সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী। আওয়ামী লীগ মনোনীত এই প্রার্থী সালমান এফ রহমান এলাকাবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, ‘ঢাকা থেকে দোহার-নবাবগঞ্জে আসতে কেরানীগঞ্জ হয়ে আসতে হয়। ভবিষ্যতে ঢাকা থেকে দোহার-নবাবগঞ্জে আসার নতুন একটি সড়ক তৈরির প্রকল্প নেওয়া হবে।’ ঢাকাকে ঘিরে থাকা মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ আর মুন্সীগঞ্জের মধ্যিখানে যদি সহজ যোগাযোগ-জাল বিস্তার লাভ করে, তবে ঢাকার ওপর চাপ কমে আসবে।

ইশতেহার অবশ্যই আশা জাগানিয়া। তবে কোনো কোনোটায় তা অনেক বেশি। যেমন, ইশতেহার ঘোষণায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘আমার গ্রাম হবে আমার শহর।’

যারাই ক্ষমতায় আসুক নগরবিদদের প্রাণের দাবি এটা। কেননা এই অঙ্গীকার ছাড়া ঢাকা আর তিলোত্তমা হবে না। কেউ কী তার বিকল্প চায়- বলুন আপনারাই।

তায়েব মিল্লাত হোসেন: সহযোগী সম্পাদক, এই সময় ও ঢাকাটাইমস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :