টাঙ্গাইলের নওয়াব শাহী মসজিদ

৯০ বছর ধরে চলছে কোরআন তেলাওয়াত

প্রকাশ | ০৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:০৩

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর ৭০০ বছরের পুরনো নওয়াব শাহী জামে মসজিদ। ২৪ ঘণ্টা এখানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা হয়। গত ৯০ বছরে এই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। মসজিদের ভেতর পালাক্রমে কোরআন তেলাওয়াত করেন আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হাফেজরা।

পীরের নির্দেশনায় কবরের আজাব থেকে মুক্তি পেতে ১৯২৭ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এ মসজিদে সার্বক্ষণিক কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করেন বলে জানা যায়। ১৯২৯ সালে মারা যান এই নবাব বাহাদুর। মসজিদের একপাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তার মৃত্যুর পরও চলছে কোরআন তেলাওয়াত।

মসজিদের খতিব ও ইমাম হাফেজ মাওলানা ইদ্রিস হুসাইন বলেন, নামাজের সময় ছাড়া এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয় না কোরআন তেলাওয়াত। টানা ৯০ বছর ধরে অবিরত চলছে এই ধারা।

বর্তমানে মসজিদটিতে সাতজন হাফেজে কারি নিযুক্ত রয়েছেন। তারা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করেন। এটি বিশ্বের বুকেও একটি বিরল ঘটনা।

ইতিহাস বলছে, সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামে দুই ভাই ১৬ শতাব্দীতে ঐতিহ্যবাহী এক কক্ষবিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সম্রাট আকবরের সময় দুই ভাই ধনবাড়ীর অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের দায়িত্ব নেন। তারাই নির্মাণ করেন মসজিদটি। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৫ বছর আগে মসজিদটি সম্প্রসারণ করে এর  আধুনিক রূপ দেন। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যুক্তবাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

সংস্কারের আগে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। সংস্কার করে মসজিদটি বর্গাকৃতির ও তিন গম্বুজবিশিষ্ট মোগল স্থাপত্যের বৈশিষ্টপূর্ণ করা হয়। মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই মসজিদের মেঝে আর দেয়াল কাচের টুকরো দিয়ে নকশাদার মোজাইক করা। মেঝেতে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। ভেতরের সব জায়গা চীনামাটির টুকরো দিয়ে মোজাইক নকশায় অলংকৃত, যার অধিকাংশ ফুলেল নকশা। এত বছরে একটু ফাটল পর্যন্ত ধরেনি সেই নকশায়। সংস্কারের কারণে প্রাচীনত্ব কিছুটা বিলীন হলেও মসজিদের সৌন্দর্য-শোভা বেড়েছে অনেক।

মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য পূর্ব দিকের বহু খাঁজে চিত্রিত খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ; উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে মোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত মসজিদটির চারদিক থেকে চারটি প্রবেশপথ এবং ৯টি জানালা এবং ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট।

মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মিহরাবটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অষ্টভুজাকার, দুই পাশে রয়েছে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান।
৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের মাথায় স্থাপিত ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। মসজিদে সংরক্ষিত রয়েছে ১৮টি হাড়িবাতি, যেগুলো শুরুর দিকে নারিকেল তেলের মাধ্যমে আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। মোগল আমলে ব্যবহৃত তিনটি ঝাড়বাতিও রয়েছে।

সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের পাশেই রয়েছে শানবাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। সেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। তার ওয়াকফকৃত সম্পদের আয় দিয়ে মসজিদ, পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসা ও ঈদগাহ পরিচালিত হয়।
মসজিদের পাশে প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর বিশাল দিঘি। তাতে শানবাঁধানো ঘাট। সেখানে মুসল্লিরা অজু করেন। তা ছাড়া মসজিদের আশপাশে সুপ্রশস্থ ও খোলামেলা অনেক জায়গা রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ করে।

কিন্তু বর্তমানে ময়লা-আবর্জনায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দিঘিটি। শতাধিক বছরের পুরনো এ দিঘির পাড়ে নির্মিত বসতবাড়ির নিত্যব্যবহার্য আবর্জনা ও পয়োনিষ্কাশন পাইপ লাইনের নোংরা পানিতে দূষিত হচ্ছে এর পানি।

একসময় এই দিঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ হতো, চলত মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। এখন আর আগের মতো মাছ চাষ হয় না। শুষ্ক মৌসুমে সব পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলেও উত্তর টাঙ্গাইলের এই সবচেয়ে বড় দিঘির পানি স্থির থাকে।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি নওয়াব শাহী জামে মসজিদটি দেখতে, কোরআন তিলাওয়াত শুনতে এবং এখানে নামাজ পড়তে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বহু মানুষ আসেন। ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এ মসজিদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার মসজিদটির সংস্কার করুক এমনটিই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।