১০ কোটি খরচের পর মূল্যায়ন, ‘কাজে আসবে না প্রকল্প’

রেজা করিম
 | প্রকাশিত : ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫৩

উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্নকে যানজট নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হিসেবে দেখিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। প্রকল্প গ্রহণের আগে বহুবার হয়েছে মূল্যায়ন সভা। তবে ১০ কোটি টাকা খরচ করার পর নতুন করে মূল্যায়ন হয়েছে এই ইউটার্নে কাজ হবে না। ফলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে কাজ।

বিষয়টি জানতে পেরে নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেছেন, সরকারি অর্থের এই অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর দায় যারা প্রকল্প অনুমোদন করেছেন তাদেরই নিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ চলতেই থাকবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছেন, তিনি এই প্রকল্প গ্রহণ করতেই নিষেধ করেছিলেন। পরিবহন কৌশলগত পরিকল্পনার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক ছিল। কিন্তু জনতুষ্টির জন্য এটি নেওয়া হয়।

প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় সামাজিকমাধ্যমে একজন প্রকৌশলীর পোস্ট করার পর। সে সময়ে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক একে যানজট নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে বর্ণনা করে গাজীপুর থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত ২২টি ইউটার্ন নির্মাণের কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত আবদুল্লাহপুর থেকে ১১টি নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।

তবে উত্তরার রাজলক্ষ্মী, উত্তরাতেই র‌্যাব-১ এর প্রধান কার্যালয়ের পাশে এবং কাউলায় তিনটি ইউটার্নের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু ওই এলাকার পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউটার্ন নির্মাণে ২০১৫ সালের শেষ দিকে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও অনুমোদন পেতেই চলে যায় অনেকটা সময়।

কাজ শুরু হয় ২০১৭-এর নভেম্বরে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০১৮’র জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ডিএনসিসি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বললেও এখনো পর্যন্ত অনুমোদন মেলেনি। এর মধ্যে তিনটির কাজ ধরে বাকিগুলোর কাজ শুরুই হয়নি। যদিও এরই মধ্যে ৩০ শতাংশেরও কম কাজ করে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।

ঢাকা উত্তরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই বর্তমানে ইউটার্নের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ইউটার্নের কাজে বিআরটি (র‌্যাপিড বাস ট্রানজিট) বাস্তবায়ন কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে জানিয়ে কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে মন্ত্রণালয়। এরপর বাধ্য হয়ে আমরা কাজ বন্ধ রেখেছি।’

তবে ঠিক কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।’

বিআরটি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআরটি বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার পরে আর ইউটার্নের কোনো কাজ নেই। এরই মধ্যে যে কয়টি ইউটার্ন করা হয়েছে, সেগুলো তখন ভেঙে ফেলতে হবে। কাজে এ বিষয়ে আর অগ্রসর না হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিআরটি প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কায়সার হামিদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘২০১৬ আর ২০১৯-এর বাস্তবতা এক নয়। সে সময়কার বাস্তবতায় ইউটার্নের প্রয়োজন থাকলেও বিআরটি বাস্তবায়নের পরে এটার আর প্রয়োজন পড়বে না। আর এখন ইউটার্ন করা হলেও বিআরটি বাস্তবায়নের পরে তা অবশ্যই সরাতে হবে।’

গত ডিসেম্বরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মিটিং হয়েছে জানিয়ে ‘ইউটার্ন’ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, ‘মিটিং এ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর এ বিষয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও পরিকল্পনা কমিশনকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো সাড়া মিলছে না এ বিষয়ে।’

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে আমি এ প্রকল্প যেন না নেওয়া হয়, তার জন্য অনেকবার বারণ করেছিলাম। তিনি শোনেননি। তার আশপাশে থাকা লোকদের ধারণাপ্রসূত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে এক্ষেত্রে। তারা আসলে নানাভাবে মেয়রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ইউটার্ন হলেই ঢাকার যানজট নিরসন হয়ে যাবে।’

‘শুধু ইউটার্নের ক্ষেত্রেই নয়। ঢাকার ভালো করতে এ রকম আরও অনেক ক্ষেত্রেই একই কাজ করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কাজে নেমে হতাশ হওয়ার চেয়ে কাজের আগে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।’

আরেক নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে সমন্বয়ের চরম অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এত অল্প সময়ের জন্য এ রকম ব্যয়বহুল প্রকল্প হয় না। যারা এমন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন, এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে।’

‘ইউটার্ন যে কোনো কাজে আসবে না- এমন কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। তবে এটা করতে হবে স্থান ও পরিস্থিতি বুঝে। ইউটার্ন করতে গেলে বিআরটি ও এমআরটির সঙ্গে সমন্বয় করেই তা করতে হবে।’

দুই বিশেষজ্ঞই বলেছেন, যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই সব সম্ভাবনা যাচাই-বাছাই করা উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে সমন্বয়ের বিষয়টি ঠিকভাবে করা হয় না বলেই ইউটার্নের মতো ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, ঢাকার যানবাহন চলাচলের বিষয়ে এসটিপিতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। সেখানে বিআরটি, এমআরটির বিষয়ে বলা হলেও কোথাও ইউটার্নের বিষয়ে কিছু বলা নেই। তারপরও ধারণাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যার ফলেই এমন পরিণতি।

সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উত্তরার রাজলক্ষ্মী, উত্তরা র‌্যাব-১ কার্যালয় সংলগ্ন জায়গা, কাউলা ছাড়াও উত্তরার জসিম উদ্দিন, জোয়ার সাহারায় গলফ ক্লাব, বনানী-কাকলী মোড়, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি, ফিলিং অ্যাকাডেমি, মহাখালী ফ্লাইওভার, মহাখালী বাস টার্মিনাল ও সাত রাস্তা মোড়ে হওয়ার কথা ছিল ইউটার্নগুলো।

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :